শেষ আপডেট: 3rd May 2023 12:56
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ইউক্রেন যুদ্ধের রেশ এখনও গনগনে, চলছে রুশ বোমাবর্ষণ! অথচ এরই মধ্যে পৃথিবীর আরেক মহাদেশে তীব্র হয়েছে যুদ্ধের দামামা।
এবারের রণক্ষেত্র আফ্রিকার উত্তর-পুবে, সুদান (Sudan Civil War)। আয়তনে পেল্লায়, আফ্রিকার তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। যদিও অর্থনীতি অতীব নড়বড়ে, মুখ্যত কৃষিনির্ভর। একদিকে বয়ে যাচ্ছে লোহিত সাগর (Red Sea), অন্যদিক ক্রমশ গিয়ে মিশেছে ধু ধু সাহারার প্রান্তরে। মাঝে সুদানের রাজধানী খার্তুমের কাছে ব্লু নীল এবং হোয়াইট নীল—দুই উপনদী মিশে যাত্রা শুরু করছে ইতিহাস-বিখ্যাত নীল নদ (River Nile), এগিয়ে চলেছে মিশরের দিকে।
এ'হেন সুদান জুড়ে শুরু হয়েছে তীব্র লড়াই (Sudan Civil War)—রাজধানী খার্তুমে চলছে বিমানহানা, কার্যত শ্মশানে পরিণত হয়েছে আফ্রিকার অন্যতম জনবহুল শহর, দাউদাউ করে জ্বলছে সুদানের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। মৃতের সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়েছে, আহত চার হাজারের বেশি, রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফে আশঙ্কা করা হচ্ছে, অন্তত ৮ লক্ষ নাগরিক প্রাণভয়ে দেশছাড়া হতে পারেন। ভারতীয় বিদেশমন্ত্রক শুরু করেছে উদ্ধারকাজ, খার্তুমের ভারতীয় দূতাবাস ইতিমধ্যেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে ৮৫০ কিলোমিটার দূরে, লোহিত সাগরের ধারের পোর্ট সুদান শহরে।
খানিক ইতিহাস
সুদানের এই যুদ্ধের নেপথ্যে রয়েছে দুই যুযুধান বাহিনী— সুদানি সেনাবাহিনী এবং অত্যন্ত শক্তিশালী আধাসেনা বাহিনী 'র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স' বা আরএসএফ। এককালে দুই দল ছিল একে অপরের মিত্র। তাহলে? এটা বুঝতে গেলে অন্তত তিন দশক পিছিয়ে যেতে হবে।
১৯৮৯ সাল। সুদানে ক্ষমতায় আসীন শেষ গণতান্ত্রিক সরকার, যার মাথায় সাদিক আল-মাহদি। অক্সফোর্ড থেকে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্নাতক, গভীরভাবে সুফী ধারায় ঋদ্ধ সাদিকের আমলে বহু রাজনৈতিক বিতর্ক থাকলেও কখনও গণতন্ত্রে কালি পড়েনি। ১৯৮৯ সালে এক ডামাডোল আর্থিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সুদানে সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতার দখল নেন কর্নেল ওমর আল বশির। তারপর তিরিশ বছর তিনিই ছিলেন সুদানের সর্বেসর্বা একনায়ক। অগুনতি অভিযোগে বিদ্ধ, দারফুর যুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ ওঠা বশিরকে শেষ পর্যন্ত ২০১৯ সালে আরেক সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
সেই অভ্যুত্থানে হাতে হাত মিলিয়েই কাজ করেছিল আজকের যুযুধান দুই পক্ষ (Burhan Dagalo Conflict), সুদানি সেনা এবং আরএসএফ। গণ্ডগোল শুরু তার পর থেকে। যার মাথায় এই গল্পের দুই নায়ক—সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফতাহ আল-বুরহান (Abdel Fattah al-Burhan) এবং তাঁর ডেপুটি জেনারেল মোহম্মদ হামদান দাগালো বা 'হেমেত্তি' (Mohamed Hamdan Dagalo)— যে নামে তাঁকে সবাই চেনে।
ক্ষমতার দখল নেওয়ার পরেই জল্পনা শুরু হয়, আরএসএফ-কে সুদানি সেনাবাহিনীরই অংশ করে নেওয়া হবে। কিন্তু এতেই আগুনে ঘি পড়ে। বুরহান এবং দাগালো অ্যাদ্দিন প্রায় স্বাধীনভাবে নিজেদের মত চলছিলেন। কিন্তু আরএসএফ সেনাবাহিনীর অংশ হয়ে গেলে প্রশ্ন উঠবেই, তাহলে পদমর্যাদায় কার নিচে কে থাকবেন? সেনাবাহিনী কার্যক্ষেত্রে সুদানের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী, অর্থনীতির নানা কলকাঠি তাদের হাতেই। ফলে শেষ অবধি যে ক্ষমতার মাথায় বসবেন, তাঁর ভাঁড়ারই একেবারে কানায় কানায় থাকবে।
দুই যুযুধান সমরনায়ক
৬২ বছর বয়সি আল বুরহানের জন্ম উত্তর সুদানে। সামান্য সৈনিক হিসেবে কাজ শুরু করে ধীরে ধীরে পদমর্যাদায় ওপরে ওঠেন তিনি, লড়েছেন দারফুর (Darfur)-সহ বিভিন্ন রণাঙ্গনে। সুদান ছাড়াও জর্ডন ও মিশরেও তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। অন্যদিকে দাগালো বা 'হেমেত্তি' (Hemedti) জন্মসূত্রে দারফুরেরই মেহরিয় জনজাতির। এরা ঐতিহাসিকভাবে দক্ষিণ সাহারার যাযাবর আরব উপজাতির অংশ। অতীব প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছোটবেলা কাটায় প্রথাগত পড়াশোনার তেমন সুযোগই পাননি তিনি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, হেমেত্তির এহেন শিকড়ের জন্য খার্তুমের উচ্চশ্রেণিতে বিস্তর কথা শুনতে হয়েছে তাঁকে। সহজাত প্রতিভাতেই তিনি দারফুরের কুখ্যাত 'জানজাউইদ' বাহিনীতে জায়গা করে নেন।
এই 'জানজাউইদ' আদতে সুদান ও চাদ সীমান্তে সক্রিয় থাকা এক সশস্ত্র বাহিনী, দারফুর যুদ্ধের অন্যতম অংশ। বিস্তর হিংসা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উঠেছে এদের বিরুদ্ধে।
দাগালো ততদিনে বশিরের নেকনজরে পড়ে গিয়েছেন। পদোন্নতিও ঘটেছে। ২০১৩ সালে এই 'জানজাউইদ' থেকেই 'র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স' বা আরএসএফ বাহিনী তৈরি করেন বশির। মাথায় বসান তাঁর বিশ্বস্ত 'হেমেত্তি'কে। মাত্র ৬ বছরের মধ্যেই দাগালো একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যাবেন, সম্ভবত ভাবেননি বশির।
আল-বুরহান এবং দাগালো— দু'জনেরই উত্থানের গল্প একইরকমের। দু'জনেই সিঁড়ি ভেঙে একেবারে নিচ থেকে ওপরে উঠেছেন। দু'জনেই ছিলেন বশিরের বিশ্বস্ত, পরে ঘুরে যান। দু'জনেই বিশাল বাহিনী এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিপুল আর্থিক সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক। দু'জনেই অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী। নজর ক্ষমতার শীর্ষে। অতএব আপাতত একজন আরেকজনকে পুরোপুরি নির্মূল না করে থামবেন না— মনে করছেন সুদান-বিশেষজ্ঞরা।
পারিপার্শ্বিক অবস্থা
সুদানের এই গৃহযুদ্ধে (Sudan Civil War) ইতিমধ্যেই বাইরের রঙ লাগতে শুরু করেছে। 'হর্ন অফ আফ্রিকা'-র একেবারে দক্ষিণে, লোহিত সাগরের নৈকট্য সুদানের আঞ্চলিক গুরুত্বকে সীমাহীন বাড়িয়ে দিয়েছে। এদিকে সুদানের প্রতিবেশী চাদ, ইথিওপিয়া, দক্ষিণ সুদান সর্বত্রই পরিস্থিতি টালমাটাল। সুদানের সঙ্গে ইথিওপিয়ার সম্পর্কও শীতল। সংবাদসংস্থা সিএনএন জানাচ্ছে, সুদানের এই যুদ্ধে ঢুকে পড়েছে রাশিয়ার কুখ্যাত 'ওয়্যাগনার' সামরিক গ্রুপ, যারা আরএসএফ-কে নানাভাবে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। সংখ্যাতত্ত্বের বিচারেও পরিস্থিতি জটিল। সুদানি সেনা সংখ্যায় ভারি, প্রায় ২ লক্ষ ২০ হাজার সক্রিয় সেনা রয়েছে। তুলনায় আরএসএফ ৭০ হাজারের কাছাকাছি হলেও অস্ত্র ও প্রশিক্ষণে তারা নাকি অনেকটাই এগিয়ে।
ঘোর সংকটে সাধারণ মানুষ
এই পুরো যুদ্ধটাই চলছে রাজধানী খার্তুমকে ঘিরে। গোটা খার্তুম কার্যত ভূতুড়ে শহরে পরিণত হয়েছে। কোথাও জল নেই, খাবার নেই, ওষুধের দোকান খোলা নেই, হাসপাতালগুলো ধুঁকছে। রাস্তায় পড়ে আছে মৃতদেহ, মর্গগুলো উপচে পড়ছে। 'সুদান ডক্টর্স ট্রেড ইউনিয়ন'-এর সচিব ডাঃ আতিয়া আবদুল্লা মার্কিন 'ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও'-কে জানিয়েছেন, প্রায় ৭০%-এর বেশি হাসপাতাল কাজ করছে না। বিভিন্ন দেশ তাদের দূতাবাস সরাতে শুরু করেছে। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। 'ওয়াশিংটন পোস্ট' সূত্রে খবর, অনেক নাগরিকই ভিসার আবেদন করে পাসপোর্ট জমা করেছিলেন, কিন্তু দূতাবাস পাত্তাড়ি গুটিয়ে নেওয়ায় তাঁরা চরম সংকটে, কারণ পাসপোর্ট ফেরত পাননি। সুদান এমনিতেই গরিব দেশ, অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। ফলে ইতিমধ্যেই প্রায় ২০ হাজার সাধারণ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন পড়শি চাদে, দলে দলে লোক চলে যাচ্ছেন দক্ষিণ সুদানে, মিশরের দিকেও উদ্বাস্তু-স্রোত।
সমাধানসূত্র মিলবে কি?
এই সমস্যার শেষ কবে, আন্দাজ করতে পারছেন না কেউই। সবারই বক্তব্য, দুই যুযুধান 'জেনারেল' অন্তত একজনকে ঘায়েল না করলে আলোচনায় বসবেন না। ততক্ষণে ক্ষয়ক্ষতি চিকিৎসার বাইরে চলে যাবে। মার্কিন রাষ্ট্রসচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন জানিয়েছেন, তিনি সরাসরি বুরহান এবং দাগালোর সঙ্গে কথা বলেছেন। মধ্যস্থতা করতে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহীও উদ্যোগী হয়েছে। তাতে চিঁড়ে ভেজে কিনা— সেটাই দেখার।
ভারতের বিশেষ হেল্পলাইনঃ
ভারতীয় বিদেশমন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছে, দূতাবাসে যোগাযোগ করার জন্য +249 999163790; +249 119592986; +249 915028256 এই নম্বর এবং ইমেল সংযোগের জন্য [email protected] আইডিতে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
গ্লেনারিজের সামনে সেলফি তুলতে টিকিট চালু হলে দার্জিলিং-এর অর্থনীতিটাই পালটে যেত কি?