দ্য ওয়াল ব্যুরো: শ্রমিকদের ব্যস্ত কলরবে চারদিক মুখরিত। সংখ্যাটা প্রায় হাজার দশেক! কেউ ইট গাঁথছেন, কারও মাথায় সিমেন্টের বস্তা। কেউ আবার বালির পাহাড়ে কোদাল চালাচ্ছেন। চার দিক নির্মাণকাজের ধুলোয় ছেয়ে আছে। ঘটনাস্থল ইথিওপিয়া। চলছে বিশাল এক বাঁধের নির্মাণ। যে বাঁধের উপরে নির্ভর করছে বিশ্বের দীর্ঘতম নদ নীলের ভবিষ্যৎ।
[caption id="attachment_45582" align="aligncenter" width="900"]

চলছে বাঁধের নির্মাণ।[/caption]
সূত্রের খবর, এই 'গ্র্যান্ড রেনেসাঁ' বাঁধের ৬০ শতাংশ নির্মিত হয়ে গিয়েছে। এর মধ্য়েই অনেকটা বদলে গেছে নীলনদের গতিপথ। শুধু তা-ই নয়। বাঁধ, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, তাকে ঘিরে আনুষঙ্গিক যা যা বদল আসবে নীলনদের চরিত্রে, তাতে খুব শিগ্গিরিই পুরোপুরি শুকিয়ে যেতে পারে বিশ্বের দীর্ঘতম নদী। পরিবেশকর্মীদের একাংশ জানিয়েছেন, জলবায়ুর আশঙ্কাজনক পরিবর্তন, জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি এবং তার উপর শরীরজুড়ে এই বিশাল নির্মাণ কাজের প্রভাবে ইতিমধ্যেই শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে নীলনদ।
৮০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে নির্মীয়মাণ, ৫৫৮ ফুট উঁচু এই বাঁধটি তৈরি করার খরচ ৪৭০ কোটি ডলার। ইথিওপিয়ায়, সুদান সীমান্ত ঘেঁষা এই বাঁধ এলাকায় আশপাশের অসংখ্য গাছপালা কেটে ফেলা হয়েছে। নদীর বুকে বেশ কয়েক স্তরে কংক্রিটও গাঁথা হয়ে গিয়েছে। ফলে বদলে গিয়েছে ওই অংশে নদীর গতিপথ।
[caption id="attachment_45584" align="aligncenter" width="1086"]

কমে আসছে নীলনদের জল।[/caption]
এই বাঁধপ্রকল্প নিয়ে প্রথম থেকেই আপত্তি জানিয়েছিল ইজিপ্ট সরকার। কারণ গোটা দেশের জলসরবরাহ নীলনদের উপর নির্ভরশীল। এত বড় বাঁধের বিশাল নির্মাণের কারণে যে ভাবে গতিপথ বদলাবে নদীর, তাতে ইজিপ্টে জল পৌঁছনোয় বেশ সমস্যা হবে। এমনিতেই মরুভূমির দেশে বৃষ্টি হয় নামমাত্র। নীলনদের জলও যদি কমে যায়, তা হলে সারা দেশের জল সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে চাষবাসও। যার ফলে বড় সমস্যার মুখে পড়তে পারে ইজিপ্ট।
[caption id="attachment_45583" align="aligncenter" width="620"]

দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে অববাহিকা।[/caption]
তথ্য বলছে, মিশরের জনসংখ্যা প্রায় দশ কোটি ছুঁয়েছে। এবং তা ক্রমবর্ধমান। আগামী ৫০ বছরে সে দেশে মানুষের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এই জনসংখ্যার প্রায় পুরোটাই নীলনদের অববাহিকায় বসবাস করে। নদীকেন্দ্রিক জীবন তাঁদের। এই অবস্থায় যদি নদীর জলের প্রবাহ কমে যায়, জলকষ্ট শুরু হয়, তা বড় সংখ্যক মানুষের উদ্বেগের কারণ হবে। এই সমস্ত যুক্তিতেই ইজিপ্ট বিরোধিতা করেছিল নীলনদের উপর অত বড় বাঁধ নির্মাণের। শুধু ইজিপ্টই নয়, এত বড় নদীটির ভরসায় রয়েছে কেনিয়া, সুদান, কঙ্গো, উগান্ডার মতো আরও ১১টি দেশ।
[caption id="attachment_45588" align="aligncenter" width="450"]

দ্রুত বাড়ছে জনসংখ্যা, প্রায় পুরোটাই নীলনদের কোলে।[/caption]
তবে এই সব কোনও যুক্তিই শুনতে রাজি নয় ইথিওপিয়া। ছ'হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্নকারী এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প একাধিক দেশে বিদ্যুৎ পরিষেবা পৌঁছে দেবে বলে দাবি তাদের। সেখান থেকে পরিবর্তন আসবে অর্থনীতিতেও। কিন্তু অর্থনীতি আগে, না পরিবেশ আগে-- এই প্রশ্নে এখনও সমঝোতায় আসতে পারেনি ইথিওপিয়া ও ইজিপ্ট।
[caption id="attachment_45585" align="aligncenter" width="500"]

নীলনদের দু'পাশে এভাবেই বাস করেন কৃষিজীবী মানুষ।[/caption]
শুধু তা-ই নয়। উইকিলিকসের ফাঁস হওয়া তথ্য থেকে জানা গিয়েছিল, এই বাঁধ নির্মাণের বিরোধিতা করতে যুদ্ধ ঘোষণার কথাও ভেবেছিল মিশর। এমনকী বিমান হামলায় বাঁধটি ধ্বংস করা নিয়েও আলোচনা হয়। কিন্তু পরে, অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা ভেবে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল হয়। এ থেকেই বোঝা যায়, এই বাঁধ ইজিপ্টের বড় চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে।
[caption id="attachment_45587" align="aligncenter" width="640"]

জলকষ্টের আঁচ বাড়ছে।[/caption]
চিন্তার সঙ্গত কারণও রয়েছে। যে গতিতে এগোচ্ছে বাঁধের নির্মাণ, যে গতিতে বাড়ছে দূষণ, নীলনদের গতিপথে যে বদল আসছে, যে দ্রুততায় শুকিয়ে যাচ্ছে নদীর জল, তাতে লাগাম টানতে না পারলে ইজিপ্টের একটা বড় সংখ্যক মানুষকে নতুন বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে তীব্র জলকষ্টের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে গোটা দেশ।
[caption id="attachment_45586" align="aligncenter" width="1920"]

এই ছবি হয়তো বদলে যেতে পারে আগামী কয়েক বছরে।[/caption]
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, শুধু ইজিপ্ট নয়। এত বড় একটা নদী শুকিয়ে যেতে শুরু করলে তা বিশ্ব-পরিবেশের জন্যও বেশ আশঙ্কাজনক। যে নদীর কল্যাণে মানবসভ্যতার শুরু, যে নদীর স্রোতের সঙ্গে বয়ে গিয়েছে ইতিহাসের নুড়িপাথর, সে নদীর এই আসন্ন ধ্বংসের বার্তায় কি আদৌ নড়ে বসবে সভ্যতা?