মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ এবং কলকাতার পুলিশ কমিশনার মনোজ ভার্মা।
শেষ আপডেট: 17th September 2024 21:51
দ্য ওয়াল ব্যুরো: আরজি কর কাণ্ডে এমনিতেই নাগরিক সমাজের বড় অংশের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ রয়েছে। তা গণগণে রাখতে আবার প্রতি মুহূর্তে সমাজ মাধ্যমে ইন্ধন জোগাচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। যা খুব স্বাভাবিকও বটে। এহেন পরিস্থিতিতে এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে সরকারের দুই ‘মনোজ’।
সোমবার রাতে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কথা দিয়েছিলেন। কলকাতার পুলিশ কমিশনার পদ থেকে বিনীত গোয়েলকে সরানো হবে। চব্বিশ ঘণ্টার আগেই সেই প্রতিশ্রুতি পালন করেছে সরকার। বিনীতকে সরিয়ে কলকাতার পুলিশ কমিশনার করা হয়েছে সিনিয়র আইপিএস অফিসার মনোজ ভার্মাকে। কিন্তু এই হস্তান্তরের প্রকাশের পরক্ষণেই আবার স্লোগান উঠেছে, ‘বদলি নয় বদল চাই’। অর্থাৎ মনোজ ভার্মাকে এই যে বদলি করে আনা হল, তাতে সন্তুষ্ট নয় জনতা, প্রশাসন ও পুলিশের আচরণেও বদল দেখার জন্য অসহিষ্ণু।
প্রশ্ন হল, মনোজ কি পারবেন সেই চ্যালেঞ্জ সামলাতে? কলকাতার পুলিশ কমিশনার পদে মনোজ ভার্মা যেমন নতুন মুখ, তেমনই মুখ্য সচিব পদে মনোজ পন্থেরও সবে দু’সপ্তাহই হয়েছে। সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে এই দুই মনোজের কাঁধেই এখন অনেক কিছু?
প্রশাসন ও পুলিশের এই দুই মনোজ একেবারেই ভিন্ন মেরুর। তবে তাঁদের দুজনেরই ক্যারিয়ারের কাহিনী অসামান্য।
বিশ বছর আগে মুর্শিদাবাদের জেলা শাসক ছিলেন মনোজ পন্থ। সেই সময়ে পালস পোলিও অভিযান চলছে। জেলাশাসক হিসাবে মনোজের দায়িত্ব ছিল, জেলার প্রতিটি শিশু যেন পোলিওর টিকা নেয়। অথচ মুর্শিদাবাদের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে পোলিওর টিকা নেওয়া নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা ছিল। অনেকে মনে করত, পোলিওর টিকা খেলে প্রজনন ক্ষমতা কমে যায়। সেই ভ্রান্ত ধারণা ভাঙতে পালস পোলিও অভিযানের দিনগুলোতে মনোজ পন্থ তাঁর ছোট্ট মেয়ে আরুষিকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে যেতেন। সংখ্যালঘুদের সামনে পোলিওর টিকা খাওয়াতেন মেয়েকে।
এহেন মনোজকে তাঁর ব্যক্তিগত সচিব করেছিলেন ইউপিএ সরকারের মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রণববাবু যখন অর্থমন্ত্রী তখন নর্থ ব্লকে তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি ছিলেন মনোজ পন্থ। কেন্দ্রের সরকারের জয়েন্ট সেক্রেটারি পদ মর্যাদার অফিসার ছিলেন মনোজ। বরাবর ঠাণ্ডা মাথা। অসম্ভব পরিশ্রম করতে পারতেন। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাল রেখে উষা নিশা শনিবার রবিবার কোনও সময়েই না ছিল না মনোজের। পরবর্তীকালে ওয়াশিংটনে বিশ্ব ব্যাঙ্কের সদর দফতরে ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে দীর্ঘ সময় ছিলেন মনোজ পন্থ।
আরজি কর কাণ্ডের পর আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনা, দৌত্য ও সমাধানের পথ বের করতে মনোজ যেভাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গত করছেন তা ইতিমধ্যেই প্রশংসিত হচ্ছে। বড় কথা হল, শাসক দল তো বটেই বিরোধী রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারাও মনোজের ব্যাপারে আস্থাশীল। কারণ, তাঁর ভাবমূর্তি স্বচ্ছ। কোনও অভিযোগও নেই তাঁর বিরুদ্ধে।
কলকাতা পুলিশের নতুন কমিশনার মনোজ ভার্মারও পুলিশি ক্যারিয়ার সামান্য নয়। তাঁকে দাবাং পুলিশ কর্তাও বলা চলে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার—জমানা নির্বিশেষে যে পুলিশ কর্তারা দক্ষতার কারণে বার বার নজর কেড়েছেন মনোজ ভার্মা সেই তালিকার প্রথম সারিতে থাকা অফিসার। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ছিলেন মনোজ। মাওবাদী হামলা ঠেকাতে নাস্তানাবুদ জেলা পুলিশের মনোবল ফেরাত মনোজের উপর আস্থা রেখেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনের পর দিন রাতের পর রাত জঙ্গল মহলে অভিযান চালিয়ে গিয়েছেন মনোজ। জলপাই পোশাক পরা সেই মনোজের ছবি এখনও বহু সংবাদমাধ্যমের ফ্রেমে ধরা রয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের মাথা কিষেনজি ওরফে কোটেশ্বর রাও যৌথ বাহিনীর অভিযানে নিহত হন। সেই অপারেশনের সময় মনোজ ছিলেন কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ফোর্সের অন্যতম মাথা। পরবর্তী কালে অশান্ত দার্জিলিংয়ে শান্তি ফেরাতে মনোজের বড় ভূমিকা ছিল।
পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়াদে মনোজ ভার্মা ক্রমশই হয়ে ওঠেন পুলিশ বাহিনীর 'মিস্টার ডিপেন্ডেবল'। উনিশের লোকসভা ভোটে ব্যারাকপুরে বিজেপির টিকিটে অর্জুন সিং জিতে আসার পর শিল্পাঞ্চলের পরিস্থিতি রাতারাতি বদলে যায়। খুন, রাহাজানি, বোমা, গুলিতে সন্ত্রস্ত ব্যারাকপুরকে শান্ত করতে মুখ্যমন্ত্রী মনোজের উপরই আস্থা রেখেছিলেন।
পুলিশের মধ্যেও মনোজকে নিয়ে নানান গল্পও রয়েছে। অনেকে বলেন, পদমর্যাদার ওজন মনোজকে যেন কখনও ছুঁতে পারেনি। পুলিশ সুপার কিংবা ডিআইজি, আইজি, এডিজি পদে থেকেও মনোজের পরিশ্রমে কখনও ঘাটতি দেখা যায়নি। বলতে গেলে, ব্যাটেলিয়নের কনস্টেবলের থেকে আলাদা করা যায়নি। ছুটি ছাটার বালাই নেই, কোনও সমস্যা হলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে দু’দণ্ডও ভাবেন না।
সন্দেহ নেই এহেন দুই মনোজের কাছে এখন মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যাশা অনেক। সাধারণ মানুষেরও তাই। আস্থা ফেরানোর ভার এখন তাঁদের কাঁধে।