অস্মিতা সোম, ২০১৬ সালের এসএলএসটি উত্তীর্ণ।
শেষ আপডেট: 28th April 2024 20:08
অস্মিতা সোম, বর্ধমান
২০১৬ সালের এসএলএসটি উত্তীর্ণ
শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্ন ছিল ছোট থেকে। বাড়িতে মা ছিলেন শিক্ষিকা। এখন অবসর নিয়েছেন। তাঁকে দেখে বড় হয়েছি। আর মনে মনে একটা ইচ্ছা লালন করে চলেছি, যেন মায়ের মতো হই। শিক্ষিকা। সেই যুগে মা ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলেন। মাসি-মেসোমশাই সবাই পিএইচডি করেছেন। তাই পড়াশোনা ও গবেষণার জীবনই আমি বেছে নিয়েছিলাম। অথচ সেই স্বপ্ন, সেই ইচ্ছে, আশা, ভবিষ্যৎ সবই এখন পুরোপুরি শেষ হয়ে গেল। হঠাৎ করে যেন অনিশ্চিয়তার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হল আমাকে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল না। কোনও কথা বলল না। দুম করে চাকরিটা চলে গেল।
আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাড়ি বর্ধমানে। ২০০৫-এ মাধ্যমিক দিই। প্রায় ৮৬ শতাংশ নম্বর ছিল আমার। উচ্চমাধ্যমিকেও নম্বর পেয়েছিলাম ৯০ শতাংশের কাছাকাছি। স্নাতকে বর্ধমান উইমেন্স কলেজ থেকে ইংরেজিতে সাম্মানিক-সহ ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে এবং তারপর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতেই ফার্স্ট ক্লাস-সহ স্নাতকোত্তর পাশ করি।
স্নাতকোত্তরের পরে শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে আমি বিএড করি বর্ধমানের সরকারি বিএড কলেজ থেকে। নেট এবং সেট দিই, দুই পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ হই। পড়াশোনার পাশাপাশি গবেষণায় আগ্রহ ছিল, তাই এমফিল করি, একইসঙ্গে বর্ধমান রাজ কলেজের মত নামী কলেজে পড়িয়েছি। পাঁচ বছর সেখানে চাকরি করার পরে আমাদের "স্যাক্ট" (স্টেট-এডেড কলেজ টিচার বা সরকার পোষিত কলেজ শিক্ষক) পদে উত্তীর্ণ করা হয়। এছাড়া কলেজ সার্ভিস কমিশনের ইন্টারভিউতেও ডাক এসেছে। পড়ানোর পাশাপাশি গবেষণার কাজও চালিয়ে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে আমি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ এশীয় ডায়াস্পোরার ওপর পিএইচডি করছি। ইতিমধ্যেই আমার পাঁচটি গবেষণাপত্র বিভিন্ন গবেষণা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
২০১৬ সালের এসএলএসটিতে যখন আমি কাউন্সেলিং-এর জন্য ডাক পাই, তখন আমি কলেজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে সেখানে যোগ দিই। এর মধ্যে কিন্তু ২০১৫ সালের আপার প্রাইমারি টেট পরীক্ষাতেও কাউন্সেলিং-এর জন্য ডাক পাই। কিন্তু যেহেতু আমি এখানে যোগ দিয়েছি, তাই ওখানে আর যাইনি। তাহলে বুঝতেই পারছেন, আমি দু-দুটো চাকরি ছেড়ে এখানে যোগ দিয়েছিলাম। অথচ আমার যোগ্যতা, আমার অধ্যাবসায়, এত দিনের চেষ্টার কোনও মূল্যই দেওয়া হল না। অযোগ্যদের সঙ্গে আমাকে এক করে দেওয়া হল। বলে দেওয়া হল, গোটা প্যানেলই বাতিল।
আমার বাবা মায়ের বয়স হয়েছে। তাঁদের যে একটা স্বপ্ন ছিল, আমাকে নিয়ে তাঁদের যে একটা ভবিষ্যতের ভাবনা ছিল, সেসব একেবারে চোখের সামনে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। আমরা সব হারালাম। এত কষ্ট করে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়ে নিজেদের যোগ্যতায় চাকরি পেয়ে বাকি দুটো চাকরি ছেড়ে জয়েন করলাম, তারপর তো আমাদের আর কিছুই রইল না। এর দায়টা কে নেবে?
চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি মা-বাবা একেবারে ভেঙে পড়েছেন। হয়তো আমার সামনে মুখে কিছু বলছেন না। সাহস দিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর। কিন্তু আমি তো বুঝতে পারছি, ওঁদের ভিতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে। আর ওরাও বুঝতে পারছে, আমার ভিতরে কেমন ভাঙাগড়া চলছে। এই বয়সে এসে এসব দেখতে হচ্ছে, এটা কি ভাবা যায়, বলুন?
আমার একটাই কথা বলার, আমাদের অযোগ্যদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না। অযোগ্যদের যাতে খুঁজে বের করা যায়, সেই চেষ্টা করুন। কিন্তু তাঁদের জন্য আমাদের এরকম পরিস্থিতি কেন হবে বলতে পারেন? আমরা কী দোষ করেছি?
হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী আমাদের মতো যোগ্যদেরও অযোগ্যদের তালিকায় রাখা হচ্ছে। তা চ্যালেঞ্জ করে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে গেছে ঠিকই। তবু আমরা এখনও আশ্বস্ত হতে পারছি না। এসএসসির বর্তমান চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার প্রথম দিন জানিয়েছেন, অভিযোগ শুধু সাড়ে ৫ হাজার প্রার্থীকে নিয়ে রয়েছে। পরে আবার বলেছেন, বাকি ১৯ হাজার প্রার্থীরও যোগ্যতা প্রমাণ করা হোক। কারণ, তিনি নাকি নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। আমার প্রশ্ন হল, ওএমআর শিট যাচাইয়ের কথা কেন বলা হল না? আদালতও কেনই বা বলল না? তাহলে তো এইভাবে প্রতারিত হতে হত না। আমরা যোগ্যতা প্রমাণের জন্য সব সময়ে প্রস্তুত।
বর্তমানে যা পরিস্থিতি, তাতে এমনিতেই সরকারি স্কুলগুলোতে শিক্ষকের সংখ্যা কম। নিয়োগ প্রক্রিয়া থমকে থমকে যাচ্ছে। এরপর যেভাবে জনমানসে বার্তা যাচ্ছে যে অযোগ্যরা চাকরি পেয়েছে, তাহলে বাবা-মায়েরা কোন ভরসায় সন্তানকে সরকারি স্কুলে পাঠাবেন? আমরা বাইরে বেরোলেই আমাদের উপহাস করা হচ্ছে। ঘুরিয়ে প্রশ্ন করা হচ্ছে, "আপনারাই কি সেই ২০১৬-এর ব্যাচ?" আমাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। দুটো চাকরি ছাড়ার পরে এরকম পরিস্থিতে এখন শুধুই হতাশা ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছি না। এটা আমার প্রাপ্য ছিল না। কিছুতেই না।