শেষ আপডেট: 8th August 2024 14:55
আমাদের জানা ছিল, অচিরেই এই দিনটি আসবে। আসবেই। যমে-মানুষে টানাটানিতে শেষ পর্যন্ত কে বিজয়ী হয়, আমরা এই সত্যটিও জানি। অনেক দিন হল পদ্মপাতায় জলের মতো তিনি ভেসে ছিলেন, তাকে আর যাই হোক, বেঁচে থাকা বলে না। আমার মতে সেজন্যই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ঠিক মৃত্যু হল না, নির্বাণ-প্রাপ্তি ঘটল। এত কষ্ট মানুষটির প্রাপ্য ছিল না, যদিও প্রকৃতির মূঢ়তায় দেখি চোর-চোট্টা-চিটিংবাজগুলোই দিব্যি বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকে আর ভাল মানুষেরা কেবলই কষ্ট পায়।
ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিস, ইদানীং সিওপিডি নামে যা ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে, বড্ড খতরনাক অসুখ। দগ্ধে দগ্ধে মারে। যাতনার প্রশ্নে এর চেয়ে অন্তিম লগ্নে ধরা পড়া কর্কটের বিষাক্ত ছোবল ভাল, ধরা পড়া আর ফুড়ুত হয়ে যাওয়ার মধ্যে বেশি সময় লাগে না। পান-সিগারেটের দোকানে এক কোণে ঝুলতে থাকা পাকানো দড়ির গোড়ায় জ্বলন্ত আগুনের মতো সিওপিডি ফুসফুসকে পোড়াতে থাকে ধীর লয়ে, মন্দাক্রান্তা ছন্দে। সময়ে সাবধান হয়ে ধূম্রপানের মৌতাতের মায়া কাটাতে পারলে নিয়মিত ডাক্তার দেখিয়ে আধ-পোড়া ফুসফুসটাকে তবু নানাবিধ ইনহেলারের সাহায্যে বেশ কিছুকাল রক্ষা করা যায়। না পারলে...
যতদূর জানি, সুখটান দেওয়ার মতো ক্ষমতা নিঃশেষিত হওয়ার আগে পর্যন্ত পারেননি। আমৃত্যু বুদ্ধদেবের প্রেমিক ছিল দুজন— রবি ঠাকুর আর সিগারেট।কিংবা নেশাও বলতে পারেন। রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে তিনি রবীন্দ্র-গানে বিভোর হয়ে থাকতেন। বাংলাদেশি গায়কদের মধ্যে ইফফাত আরা খান ছিল তাঁর বিশেষ পছন্দের। কলকাতায় যতবার ইফফাত গাইতে আসতেন, শহরে থাকলে বুদ্ধদেবকে অনিবার্যভাবে শ্রোতার আসনে দেখা যেত। ইফফাতের ঘরানা কিঞ্চিৎ অন্য রকম, ভাঙা ভাঙা কন্ঠস্বরে অন্য রকম মাদকতা আছে, অনেকটা ধোঁয়ার গন্ধ মাখা অভিজাত মল্ট হুইস্কির মতো। এই পছন্দের মধ্যে দিয়ে বুদ্ধদেব যে ভিন জাতের রবীন্দ্র-রসিক সেটা বুঝেছিলাম।
রবি-গানে ছিল মনের আরাম, চিত্তের শুদ্ধি, আত্মার শান্তি। দৈনন্দিন কুটিল-জটিল রাজনীতির মধ্যে তাঁর দু’দন্ডের মুক্ত বাতাস। গোল ঘটিয়ে দিল আত্মঘাতী অন্য প্রেমটি। জীবনে আমি চেইন-স্মোকার কম দেখিনি, আমি নিজেও তাই ছিলাম। একমাত্র বুদ্ধদেবকেই এ ব্যাপারে বেপরোয়া, স্বেচ্ছাচারী মনে হয়েছে। ঠেলায় পড়লে গোয়ালাও ঢ্যালা বয়, একমাত্র ব্যতিক্রম তিনি। অনেক বছর আগেই ডাক্তারবাবুরা তাঁর রোগ নির্ণয় করে পুনঃপুনঃ সাবধান করেছেন, কা কস্য পরিবেদনা।
ঘণ্টা খানেকের আড্ডায় দু’কাপ লাল চায়ের সঙ্গে গোটা ছয়েক সিগারেটের বাট ছাইদানিতে নির্বাপিত হত, এ আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা। দেখেছি নিকোটিনের কারণে তাঁর ডান হাতের দু’টি আঙুলের উপরিভাগ গাঢ় পীতবর্ণ ধারণ করেছে, তাঁর কোনও ভ্রূক্ষেপই নেই। কেন জানি না আমার মনে হোত, কমিউনিস্ট দলের ক্লান্তিকর অনুশাসনের নিগড়ে বাঁধা জীবনে তিনি মুক্তি খুঁজতেন ধোঁয়ার কুন্ডলী পাকিয়ে। জ্ঞানপাপীর মতো আমিও তাঁকে অনেকবার মিনতি করেছি সর্বনাশা নেশাটি ছাড়ার জন্য। সে সময় কলকাতার যে পালমনোলজিস্ট তাঁর চিকিৎসা করতেন তিনি আমার বিশেষ পরিচিত ছিলেন, তিনিই আমাকে খোঁচাতেন, বুদ্ধদেবকে এই অনুরোধ করার জন্য।
একবার তো তিনি রীতিমতো ব্যোমকে গিয়ে আমাকে কিঞ্চিত ভ্যর্ৎসনাই করে বসলেন। 'দেখুন মশাই, রাইট টু ডাই ইজ মাইন। আমি কীভাবে মরব সেটা স্থির করার অধিকারও একমাত্র আমার। এখানে কারও খবর্দারি আমি মানব না।’ বলেই জানতে চাইলেন আমার পকেটে সিগারেটের প্যাকেট আছে কিনা।