বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও প্রসাদরঞ্জন রায়।
শেষ আপডেট: 8th August 2024 19:10
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে আমি কলেজে পড়ার সময় থেকে চিনতাম। যদিও একটু দূরত্ব ছিল। উনি আমার থেকে চার বছরের সিনিয়র। কাজেই আমরা যখন ফার্স্ট ইয়ারে ঢুকি, ওঁরা তখন এমএ পড়েন। তাছাড়া ওঁরা এসএফআই করতেন। আমি তো সে সংগঠনের সঙ্গে ছিলাম না। আমরা বরং পিসিএসও করে এসএফআই-এর বিরুদ্ধেই ইলেকশন-টিলেকশনে দাঁড়িয়েছিলাম। কাজেই তখন জানার টানও ছিল না।
কিন্তু ওঁর জানাশোনা বন্ধুবান্ধব কিছু মানুষকে আমি পরে চিনি খুব ভাল ভাবে। তার মধ্যে বিশেষ করে আমার মনে পড়ছে আমার বন্ধু সুভাষ চক্রবর্তীর কথা। যিনি মন্ত্রী ছিলেন, সেই সুভাষ চক্রবর্তী নন, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক সুভাষ চক্রবর্তী ও তাঁর স্ত্রী উত্তরা চক্রবর্তী।
ওঁরা সহপাঠী। বুদ্ধদেববাবু ও অসীম দাশগুপ্ত —এই দু’জনেও ওঁদের পরিচিত ছিলেন। ওঁদের সঙ্গে ওঁর খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমার সঙ্গে বুদ্ধদেববাবুর দেখা-সাক্ষাৎ মাঝে-মধ্যে হয়েছে আমি চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর। মানে আমি বলছি ১৯৭৭-৭৮ সালের পর থেকে। কিন্তু ঘনিষ্ঠতা ছিল না। তারপর এই চাকরি করতে গেলে যেমন হয়।
আমি কখনও ভাবিনি যে ওঁর সঙ্গে সরাসরি আমাকে কাজ করতে হবে বা উনি চাইবেন যে আমি সরাসরি ওঁর দফতরে কাজ করি। তার আগে কোনওদিনও করিনি। দেখা-সাক্ষাৎ হত আমি যখন ফিন্যান্সে ছিলাম, তখন তো ওঁদের ফাইল-টাইল আসত। অনেক সময় ডেকে কথা বলতেন।
কিন্তু যখন হোম সেক্রেটারির পদ খালি হল, আমাকে ডেকে বলা হল যে বুদ্ধদেববাবু চাইছেন আমি ওই পদ সামলাই। আমি একটু আশ্চর্যই হয়ে গিয়েছিলাম। কেন না আমি পাওয়ার ডিপার্টমেন্টে ছিলাম তখন। খুব বেশিদিনও হয়নি—বছর দেড়েক হবে। আর সেখানে আমি ভালই ছিলাম। ভালই কাজ করছিলাম। তা আমাকে চিফ সেক্রেটারি বলেন একবার ওঁর সঙ্গে দেখা করতে। গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করলাম। উনি বললেন, ‘আপনি আমার এখানে আসুন।’
আমি তখন ওঁকে বলেছিলাম, ‘দেখুন আমাকে নিলে হয়তো আপনার পার্টির কোনও ব্যাপারে একটু অসুবিধা হতে পারে। কারণ আমি সোজা কথা সোজা সোজা বলতেই ভালোবাসি। আমি কোনও পাওয়ার গেম খেলতে রাজি নই। আর আমি হোম সেক্রেটারি হতে খুব উদগ্রীব —তা-ও নই।’ বুদ্ধদেববাবু আমাকে স্পষ্ট করে বললেন, ‘না, আপনি যেমন ভাল বোঝেন সেই রকমই করবেন, সেই রকমই বলবেন। আপনার উপর আমরা পার্টি থেকে কোনও রকম চাপ দেব না। আমিও কিছু বলব না।’
যতদিন কাজ করেছি সেই দুঃসহ (সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্ব) সময়টা বাদ দিলে এই রকম ভাবেই চলেছে। আমার কাজ করতে কোনও অসুবিধা হয়নি। আমি যা দেখেছি, যা রিপোর্ট পেয়েছি সেই রকমই বলা হয়েছে।
একটা ব্যাপার ছিল যেটা সেই সময়কার সাংবাদিকেরা ভালই জানেন, তখন রাইটার্সে স্বরাষ্ট্রসচিব, মুখ্যসচিব, মুখ্যমন্ত্রী প্রমুখের চেম্বারের কাছেই প্রেসরুমটা ছিল। আমার ঘর থেকে কোনও কাজে চিফ সেক্রেটারির ঘরে বা দু’জনে মিলে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে যেতে হলে সব সময়ই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে হতে হত। প্রেসের লোকেরা এসে আমাদের ধরতেন, নানা রকমের প্রশ্ন করতেন। এ ব্যাপারটাতে একটু অসুবিধা হতে পারে রুলিং পার্টির, এটা আমি বুঝেছিলাম এবং ওঁকে বলেছিলাম। যেমন অনেক জায়গাতেই আছে পুলিশেরও ডিজি-ই সব স্টেটমেন্ট দেন পুলিশের হয়ে। কিংবা ডিআইজি ল’ অ্যান্ড অর্ডার বা কেউ ওই রকম কেউ একজন স্পোকস পারসন থাকেন। আমি একদিন ওঁকে বললাম, এরকম একজন স্পোকসম্যান ঠিক করুন। তাঁকে আমরা যেমন ব্রিফ করে দেব, তিনি সেরকম বলবেন। কিন্তু উনি বললেন, ‘না, আমি চাই আপনিই থাকুন। আপনিই উত্তর দিন। আর এতে কোনও অসুবিধা নেই।’ ব্যাপারটা দাঁড়াল এই যে তার ফলেই হয়তো পরের দিকের সমস্যাটা একটু কাছাকাছি এল।
কিন্তু এই যে প্রায় তিন বছর আমরা কাজ করেছি, তখন ওঁকে অনেক অন্য ভাবে আমি দেখতে পেয়েছি। এবং খুব কাছাকাছি থেকে দেখেছি। একটা সময় মনে হত প্রায় বন্ধুর মতোই। যদিও আগেই বলেছি, উনি আমার থেকে চার বছরের সিনিয়র।
সাহিত্য নিয়ে ওঁর উৎসাহের কথা তো সবাই জানেন। সাহিত্য এবং নাটক, সিনেমা নিয়ে। এবং অনেক সময়ই কলেজের বন্ধু-বান্ধবদের কথা নিয়ে উনি আলোচনা করতেন আমার সঙ্গে। উনি যে ধরনের বইপত্র পড়তেন বা যে ধরনের সাহিত্য, নাটক নিয়ে উনি উৎসাহী, আমি যে সে সব এত পড়েছি এমন নয়। আর আমি যা পড়তে উৎসাহী উনি যে তাতে উৎসাহী তেমনটাও নয়। কিন্তু আমরা আবিষ্কার করেছিলাম একটা আশ্চর্য জিনিস, সেটা হচ্ছে ক্রিকেট নিয়ে ওঁর এবং আমার আগ্রহও প্রায় পাগলামির পর্যায়েই গিয়েছিল একটা সময়। এইটা নিয়ে আমাদের খুব যোগাযোগ ছিল। এমনকী আমরা একসঙ্গে ঘরে বসে কিছু কিছু খেলা দেখেছি। সাধারণভাবে ওঁর সঙ্গে যখন আমার কথা হত, উনি আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে কথা বলতেন। অথবা, কোনও বই নিয়ে কথা হত, ক্রিকেট নিয়ে কথা হত।
একটা ঘটনা আমার বেশ পরিষ্কার মনে পড়ে—স্টিভ ওয়া, রিটায়ারমেন্টের পর ওঁর এনজিও নিয়ে রাজ্যে একটা বাচ্চাদের হোমে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন। তখন প্রায়ই আসতেন। তার মধ্যে স্টিভ আমাকে একবার মিট করেছেন। একবার বুদ্ধদেববাবুকেও মিট করলেন। সেবার একটা বড় অটোবায়োগ্রাফিক্যাল বই অটোগ্রাফ-সহ ওঁকে দিয়েছিলেন স্টিভ ওয়া। উনি বইটা অফিসেই রেখেছিলেন। সেটা বোধ হয় খানিকটা উল্টে-পাল্টে উনি পড়েওছিলেন। তার পর একদিন আমাকে বললেন যে ‘এই এত মোটা ভারি বই, আমি আর কোথায় নিয়ে যাই। বাড়িতে আমার বই রাখার আর জায়গা হচ্ছে না। আর কাকেই বা এই বইটা দিই, স্টিভ আমাকে সই করে বইটা দিয়েছে, আপনি কি বইটা নিতে ইন্টারেস্টেড হবেন?’
আমি তো হাতে যেন স্বর্গ পেলাম। আমি বললাম, ‘বইটা আমি দেখেছি। কিনব কিনব ভাবছিলাম। তবে বেশ দাম। আমার কেনা হয়নি।’ উনি বললেন, ‘তবে আপনি এটা নিয়ে যান। আমিও বেঁচে যাই।’ তা আমি ওটা নিয়ে এলাম। বইটা পড়া শেষ করে আমি আবার ওঁকে বললাম, ‘আমার পড়া হয়ে গিয়েছে, বইটা কি আমি ফেরত দিয়ে যাব?’ উনি বললেন, ‘না, আপনার মতো একজন ক্রিকেটপ্রেমীর কাছে বইটা থাকলে আমার তো মনে হয় ভালই হবে।’
সেই সময়টায় উনি কেন, ওঁর পরিবার—ওঁর স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গেও নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ হত। একটু যোগাযোগও ছিল। যখন শেষে নন্দীগ্রামের সময়টা এল, আমি তা নিয়ে কিছু বলব না। কিন্তু আমি নিশ্চিত সব ওঁর ইচ্ছায় হয়নি।
উনি আমাকে যতটা সম্ভব প্রোটেক্ট করার চেষ্টাই করেছিলেন। কিন্তু আমি যেটা আগেও ওঁকে বলেছিলাম যে কিছু বলতে গেলে আমাকে সত্যি কথাই বলতে হবে এবং তাতে রুলিং পার্টির অসুবিধা হওয়ার কথা। এবং তাই হল। আর এটাও বলেছিলাম, যদি সেজন্য আমাকে বদলি হতে হয়, তো বদলি করার অধিকার সরকারের আছে। তাই করা হয়েছিল।
তা নিয়ে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে কোনও দাগ পড়েনি। এবং শেষ দিনেও। আগের দিন কয়েকটা কাজ নিয়ে ওঁর সঙ্গে কথা বলতে যাই। অনেক দেরি পর্যন্ত কাজও করছিলাম। সেই দিনেও উনি সহৃহয় ভাবেই আমাকে একরকম বিদায় দিলেন এবং আমি হায়ার এডুকেশনে যে ছ’মাস ছিলাম—আমার সরকারি চাকরির শেষ ছ’মাস, তার মধ্যেও যখন দু’একবার কথা বলা দরকার হয়েছিল, খুব ভালভাবেই কথা বলেছিলেন।
এরকম একজন ভদ্র শিক্ষিত মানুষ আমি সরকারি চাকরিতে দেখিনি এমন নয়, তবে কমই দেখেছি। আর এই কথাটাই বার বার আমার মনে পড়ছে। সমস্যা একটাই ছিল সেটা হল খুব বেশি স্মোক করতেন। স্মোক আমিও একসময় করতাম। ছেড়ে দিয়েছি মোটামুটি অনেককাল। উনিও ছাড়লেন, তবে অনেক পরে। আমার মনে হয় সেইটাই ওঁর মূল সমস্যার কারণ। এবং সিওপিডি একবার ভিতরে ধরে ফেললে মানুষকে সহজে নিষ্কৃতী দেয় না।
(কয়েক বছর আগে কথোপকথনের ভিত্তিতে অনুলিখন। সাক্ষাৎকার: অমল সরকার)