শেষ আপডেট: 7th July 2023 15:55
দ্য ওয়াল ব্যুরো: রহস্যময় গহ্বর। তাও আবার ভারত মহাসাগরের (Indian Ocean) নীচে। অতল সমুদ্রের গভীরে পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ হাজার (৬০০ মাইল) কিলোমিটার গভীরে দৈত্যাকার সেই গহ্বরের খোঁজ পেয়েছেন সমুদ্রবিজ্ঞানীরা। কীভাবে তৈরি হল সেই গর্ত, কোথা থেকে এল, পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রে এর প্রভাব কী পড়বে, সেই নিয়েই গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ওই গর্তে (gravity hole)পৃথিবীর অভিকর্ষজ বল ঠিকমতো কাজ করে না। অর্থাৎ মাধ্যাকর্ষণ নেই বললেই চলে। এটা কীভাবে সম্ভব হল? রহস্য তৈরি হয়েছে সেখানেই।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের দুই বিজ্ঞানী দেবাঞ্জন পাল ও আত্রেয়ী ঘোষ এই গহ্বর নিয়ে গবেষণা করছেন। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, সমুদ্রের অতলে এই গর্ত হল আসলে ‘গ্র্যাভিটি হোল’ (Gravity Hole), অর্থাৎ যেখানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করে না বললেই চলে। এই গ্র্যাভিটি হোলের (মাধ্যাকর্ষীয় গহ্বর) ভৌগলিক নাম ইন্ডিয়ান ওশিয়ান জিওড লো (Indian Ocean Geoid Low, IOGL)।
‘জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটারস’ নামক সায়েন্স জার্নালে গ্র্যাভিটি হোল নিয়ে গবেষক দেবাঞ্জন এবং আত্রেয়ীর গবেষণামূলক তত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে। কেন ভারত মহাসাগরের মাঝে ‘গ্র্যাভিটি হোল’ তৈরি হল, তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন তাঁরা।
সমুদ্রের জলস্তর থেকে ১০০ মিটার নীচে রয়েছে সেই গর্ত। গবেষকদের দাবি, মেসোজোয়িক যুগে লরেশিয়া ও গন্ডোয়ানা উপমহাদেশের মধ্যবর্তী স্থানে ছিল টেথিস মহাসাগর। পরে স্থলভাগ জুড়ে গিয়ে সেই মহাসাগর বিলুপ্ত হয়। প্রায় ২ কোটি বছর ধরে সেই প্রক্রিয়া চলে। মহাসাগর বিলুপ্ত হওয়ার সময় প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয়েছিল। ফলে পৃথিবীর অন্দর থেকে গলিত উত্তপ্ত ম্যাগমা বা লাভাস্রোত বেরিয়ে এসে ঢেকে দিয়েছিল সেই জায়গাটাকে। পরে টেকটনিক প্লেটগুলো সরে গেলে সেই জায়গার শিলা ডুবে যায়। ফলে একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়। সেখানেই পরবর্তী সময়ে বিশালাকার ওই গহ্বর তৈরি হয় বলে ধারণা গবেষকদের।
প্রায় ৩০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে সেই গর্ত তৈরি হয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সেখানে ভূপৃষ্ঠের ভর ও ঘনত্বের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। সব জায়গার ভর ও ঘনত্ব সমান নয়। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ টান সেখানে অপেক্ষাকৃত দুর্বল।
পৃথিবীর ভেতরটা অনেকটা পেঁয়াজের খোলার মতো। পরতে পরতে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন স্তর। তাদের রাসায়নিক ও ভৌত গঠন, বৈশিষ্ট্য আলাদা। সবচেয়ে বাইরের স্তরটি রাসায়নিক গঠনগতভাবে ভিন্ন, নিরেট সিলিকেট ভূত্বক যার নীচে রয়েছে ম্যান্টল। একে বলে গুরুমণ্ডল। ভূত্বক এবং গুরুমণ্ডলের উপরের অংশকে একসঙ্গে বলে লিথোস্ফিয়ার। এই অংশেই টেকটনিক প্লেটগুলো সংকুচিত অবস্থায় থাকে।
আরও পড়ুন: বিপরীতে ঘুরছে পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল? ভূমিকম্পের তরঙ্গ দেখে চমকে গেলেন বিজ্ঞানীরা
বিজ্ঞানীরা বলছেন, উপগ্রহ চিত্রে পৃথিবীর যে রূপ এখন আমরা দেখতে পাই তার সঙ্গে কোটি কোটি বছর আগের পৃথিবীর মিল নেই। একটু একটু করে রূপ বদলাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই বদলের অন্যতম কারণ হচ্ছে এই টেকটনিক প্লেট ও তার নীচে পৃথিবীর গভীরে থাকা ম্যান্টল স্তরের চলাফেরা। গলিত ম্যান্টলের প্রবাহের ফলে তার উপরের টেকটনিক প্লেটগুলোর একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। কখনও মৃদু ধাক্কা আবার কখনও জোরদার ঠোকাঠুকি হয়ে প্লেটগুলো একে অপরের থেকে দূরে সরে যায়। কখনও বা একটি প্লেট অন্যটার ঘাড়ে উঠে যায়। এই ধাক্কাধাক্কির ফলেই ভূত্বকের পরিবর্তন হয়। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গী হয় ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত বা কখনও সুনামি।
বিগত কয়েক দশক ধরে এই ম্যান্টলের গতিবিধি, টেকটনিক প্লেটগুলোর অবস্থান, সংঘর্ষের ফলে তৈরি শক্তিপ্রবাহ নিয়ে গবেষণা করছেন ভূবিজ্ঞানীরা। কম্পন মাপক যন্ত্র বা সিসমোগ্রামের সাহায্যে পাওয়া তথ্য থেকে যে গাণিতিক মডেল তৈরি করেছেন, তা থেকে তাঁরা পৃথিবীর বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে অনেক নিখুঁত ভাবে জানা গেছে। ভূমিকম্পের কারণ জানতেও তৈরি হয়েছে মডেল। এই গ্র্যাভিটি হোল ঠিক কীভাবে তৈরি হল তা জানতেই উচ্চস্তরের গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। এই গহ্বর আগামীদিনে কী সঙ্কেত বয়ে আনবে সেটাও চিন্তার বিষয়।