বাংলা সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার।
শেষ আপডেট: 12th March 2025 16:36
গর্বের সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার থেকে এ বছর বাদ পড়ল বাংলা। অন্যান্য ভাষার অ্যাকাডেমি পুরস্কার প্রায় ঘোষণা হয়ে গেলেও, বাংলা সাহিত্য অ্যাকাডেমি ছিল বিশ বাঁও জলে। অবশেষে জানা গেল, এ বছর বাংলার ভাগে পড়ছেই না এই পুরস্কার। সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারের ঐতিহ্যের ইতিহাসে এমনটা এই প্রথমবার হল বলেই জানাচ্ছে বাংলার সাহিত্যিক মহল।
সেই সঙ্গেই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, কেন এমনটা হল? দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে এগিয়ে চলা বাংলা ভাষার কোনও সৃষ্টিই সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারধন্য হল না কেন?
এই প্রশ্ন নিয়ে দ্য ওয়ালের তরফে যোগাযোগ করা হয়েছিল সাহিত্য অ্যাকাডেমির সেক্রেটারি কে শ্রীনিবাসরাওয়ের সঙ্গে। তিনি প্রথমেই নিশ্চিত করলেন, পুরস্কার দিতে দেরি হচ্ছে এমনটা নয়, এবছর বাংলায় দেওয়াই হচ্ছে না এই সম্মান। কিন্তু এর কারণ কী? শ্রীনিবাসরাওয়ের কথায়, 'এটা আমাদের অন্তর্বর্তী টেকনিক্যাল ত্রুটি। একমাত্র টেকনিক্যাল কারণেই এ বছর বাংলায় বাতিল হয়েছে এই পুরস্কার।' তাঁর কাছে ফের জানতে চাওয়া হয়, বিষয়টা এমন নয় তো, যে বাংলার কোনও বইকেই যোগ্য নির্ধারিত করা সম্ভব হয়নি? উত্তরে তিনি বলেন, 'জুরি তৈরি করার পরে, সেখানে ঝাড়াইবাছাই হওয়ার পরে কোনও লেখা নির্বাচন করা না গেলে সেটা ঘোষণা করেই জানানো হয়, যে এবছর অমুক ভাষায় কোনও বই নেই। কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে তা হয়নি। জুরি বোর্ড তৈরিই করা হয়নি, কারণ এ বছর বাংলায় পুরস্কারটি বাতিল টেকনিক্যাল কারণে।'
'টেকনিক্যাল কারণে' এই বঞ্চনার বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে পারছেন না বাংলার লেখক-কবি জগতের ব্যক্তিত্বরা। শুধু তাই নয়, অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন সেক্রেটারির দর্শানো এই কারণটিই কি প্রথম এবং প্রধান বিষয়? না এর আড়ালে অন্য কোনও সমস্যা রয়েছে?
এই নিয়ে সাহিত্য অ্যাকাডেমি বাংলার প্রাক্তন কনভেনর কবি সুবোধ সরকারকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, এই নিয়ে তাঁর কিছু বলার নেই। এক ঘণ্টা পরে কিছু বলতে পারেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি, কিন্তু তার পরে আর টেলিফোনে যোগাযোগ করা যায়নি তাঁর সঙ্গে। তাঁর প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেলে, এই প্রতিবেদনে আপডেট করা হবে।
বর্তমান কনভেনর ব্রাত্য বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও এই বিষয়ে কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। তাঁর প্রতিক্রিয়া পেলেও এই প্রতিবেদনে যোগ করা হবে।
সাহিত্য অ্যাকাডেমির পূর্বাঞ্চলের প্রাক্তন সচিব ও বাংলার কবি-লেখক অংশুমান কর প্রশ্ন তুলে বলেন, এটা খুবই বেদনার। যে সময়ে বাংলা ভাষা ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পেল, সে সময়েই বাংলা ভাষায় সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার এল না। এর চেয়ে দুঃখের কী হতে পারে?
তিনি অভিযোগ করে বলেন, "বলা হচ্ছে, 'টেকনিক্যাল কারণে' পুরস্কার দেওয়া হল না। আমার তো মনে হয় এটা খুবই মারাত্মক কথা। আমি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব, এই টেকনিক্যাল সমস্যা কী কারণে হল সেটা চিহ্নিত করতে এবং এর পিছনে যদি কোনও ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা দায়ী থাকেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। আমি নিজে যে ভাষায় লেখালেখির চর্চা করি, সে ভাষায় পুরস্কারটি না এলে আমি তো চাইবই এর যথাযথ তদন্ত হোক এবং দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। বাংলার সমস্ত লেখক-লেখিকারই এই দাবি তোলা উচিত।"
সাম্প্রতিক সময়ের সাহিত্য অ্যাকাডেমি যুব পুরস্কারপ্রাপ্ত তরুণ লেখক-ঔপ্যনাসিক শমীক ঘোষ বলেন, "সাহিত্য অ্যাকাডেমির সাধারণ নিয়মে সব ভাষাতেই পুরস্কার দেওয়ার কথা। এবং পুরস্কার দেওয়ার এই পদ্ধতি খুবই গণতান্ত্রিক ভাবে পালন করা হয় বলেই আমি জানি। এবার বাংলা কোনও পুরস্কারই পেল না, এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। বাংলাভাষা গোটা দেশের সাহিত্যের অঙ্গনে একটা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সেখানে এই ত্রুটি বা বঞ্চনা, মেনে নেওয়া যায় না।"
তবে এই দুঃখ বা বেদনার পাশাপাশি আরও বহু প্রশ্নই উঠছে এই ঘটনায়। বাংলার সাহিত্যিকদের একাংশ যেমন প্রশ্ন তুলছে, বাংলা সাহিত্য অ্যাকাডেমির নিরপেক্ষতা নিয়েই। কারণ দেখা যাচ্ছে, ব্রাত্য বসু, যিনি রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর ভূমিকা পালন করছেন, তিনিই বাংলা অ্যাকাডেমির প্রধান, তিনিই সাহিত্য অ্যাকাডেমির কনভেনর, এটা কোন গণতন্ত্রে হতে পারে? এটি সাহিত্যের গোটা প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক ভাবে কুক্ষিগত করার চেষ্টা বলে অভিযোগ উঠেছে একাধিক লেখকের তরফে। এর পরে দিল্লিতে বিজেপি-র একটা ভূমিকাও কাজ করে বলে দাবি অনেকের।
যদিও দ্বিতীয় অভিযোগটি সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন সাহিত্য অ্যাকাডেমির প্রাক্তন কনভেনর, আনন্দ পুরস্কার প্রাপ্ত সাহিত্যিক রামকুমার মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, "এবছর বাংলায় কেন সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার নেই, কী ত্রুটি হয়েছে, তা বর্তমান বোর্ড সদস্যরাই বলতে পারবেন। তবে আমি নিজে তিন দশকের বেশি সময় ধরে সাহিত্য অ্যাকাডেমিতে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এমনটা আগে কখনও হয়নি। এবং এই বিষয়ে দিল্লির কোনও হস্তক্ষেপও হয়নি কখনও। কংগ্রেস আমল হোক বা বিজেপির আমল, কেন্দ্রীয় সাহিত্য অ্যাকাডেমি থেকে বা মন্ত্রক থেকে কোনও নজরদারি বা খবরদারি করা হয় না। সমস্যাও তৈরি করা হয় না। সমস্যা কিছু হলে, তা আঞ্চলিক কারণেই হয়েছে। আরটিআই করলে জানা যেতে পারে টেকনিক্যাল সমস্যার বিষয়টি। এই নিয়ে নিশ্চয় কোনও মিটিং হয়েছে, আলোচনা হয়েছে বোর্ড সদস্যদের মধ্যে, তাঁরাই বলতে পারবেন এর কারণ। কেন্দ্রীয় সাহিত্য অ্যাকাডেমি বা মন্ত্রকের কোনও ভূমিকা নেই।"
তবে সাহিত্যমহলের একাংশ স্পষ্টভাবেই মনে করছে, 'টেকনিক্যাল সমস্যা'র যে কারণ দর্শানো হয়েছে, তা অত্যন্ত অস্পষ্ট ও আংশিক সত্য। এর পিছনে গভীর কোনও কারণ বা জটিলতা রয়েছে। অনেকে একপ্রকার নিশ্চিত, কাকে পুরস্কার দেওয়া হবে, তাই নিয়েই রাজনৈতিক কোনও সমস্যা হয়েছে এবং রাজনৈতিকভাবেই বিষয়টি পরিচালিত হয়ে পুরস্কারের রাস্তা বন্ধ করেছে। সে রাজনীতি রাজ্যের না কেন্দ্রের তাই নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকতে পারে, সংশয় থাকতে পারে দু'টি দিক নিয়েই। তবে মোদ্দা বিষয়, নিছক 'টেকনিক্যাল ত্রুটি'র কথা নির্বিবাদে মেনে নিতে রাজি নয় বাংলার লেখক মহল।