শেষ আপডেট: 23rd December 2024 18:19
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বছরভর ঘটনার ঘনঘটা যেন লেগেই রয়েছে বাংলায়। তার মধ্যে থেকেই বড় ১০টি ঘটনা নিয়ে ২০২৪ সালকে ফিরে দেখা। কয়েকটি ঘটনা যেন সেই রবি ঠাকুরের ছোট গল্পের সংজ্ঞা, 'শেষ হয়েও হইল না শেষের মতো'! সন্দেশখালি থেকে আরজি কর কিংবা চাকরি বাতিল থেকে ট্রাম-ট্যাক্সির বিলুপ্তি ঘিরে বিতর্ক অব্যাহত বর্ষশেষেও। কিংবা বলা ভাল, নিষ্পত্তি না হওয়া এমন বহু ঘটনাকে সঙ্গে নিয়েই স্বাগত জানাতে হবে ২০২৫ সালকে।
আরজি কর কাণ্ড
৮ অগস্ট গভীর রাত। আরজি করে নিজের কর্মস্থলেই ধর্ষণ-খুনের শিকার হন দ্বিতীয় বর্ষের ডাক্তারি ছাত্রী। বিচারের দাবিতে এবং সুরক্ষার প্রশ্নে জুনিয়র চিকিৎসকদের টানা কর্মবিরতি, মহিলাদের উদ্যোগে একাধিকবার রাত দখল অভিযান, আন্দোলনের ঢেউ পৌঁছে যায় দেশ বিদেশেও। সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে তদন্ত করছে সিবিআই। তবে ৯০ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা চার্জশিটে দিতে ব্যর্থ হওয়ায় জামিন পেয়েছেন আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিৎ মণ্ডল। নতুন করে মেয়ের খুনের তদন্ত চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন নির্যাতিতার মা-বাবা। কবে বিচার মেলে, সেদিকেই তাকিয়ে সকলে।
২৬ হাজার চাকরি বাতিল
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় জেলে রয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়-সহ শিক্ষা দফতরের একঝাঁক প্রাক্তন পদস্থ আমলা। অনেকে আবার জামিনে মুক্ত। চাকরির দাবিতে মাসের পর মাস রাস্তায় বসে আন্দোলন করছেন চাকরিপ্রার্থীরা। তবে যোগ্য-অযোগ্য বাছাই সমস্যার জেরে গত ২২ এপ্রিল ২০১৬ সালের এসএসসি-র নিয়োগ দুর্নীতি মামলার পুরো প্যানেলটাই বাতিল করে দেন বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ। বাতিল হয়ে যায় ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি।
হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে মামলা গড়িয়েছে সূপ্রিমকোর্টে। যোগ্যতা বাছাইয়ের মাপকাঠি ওমআরশিটের সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ভরসা বলতে 'মেটা ডেটা'! আর সেই 'মেটা ডেটা' খুঁজে বার করতে না পারলে যোগ্য-অযোগ্য তালিকা বাছাই করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে সুপ্রিমকোর্ট। মামলার পরবর্তী শুনানি হবে আগামী ৭ জানুয়ারি।
বিলুপ্তির পথে কলকাতার ট্রাম- হলুদ ট্যাক্সি
কলকাতার ইতিহাসে জোড়া ধাক্কা। পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে ১৫ বছরের বেশি পুরোনো প্রায় ২,৫০০ ট্যাক্সিকে রাস্তায় নামার অযোগ্য ঘোষণা করেছে সরকার। ফলে বিলুপ্তির পথে কলকাতার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা হলুদ ট্যাক্সি। হারিয়ে যেতে বসেছে কলকাতার দেড়শো বছরের প্রাচীন যান ট্রামও। আধুনিকতার সঙ্গে পাল্লা দিতে বেমানান এই ট্রাম নাকি এখন শহরের বোঝা! তার শ্লথ গতি, বড়সড় চেহারা, নিজের পথে নিজের মতো দূষণহীন চলা-- এসবই নাকি বিড়ম্বনা! এমনকী ট্রামলাইনের জন্য নাকি ঘটছে দুর্ঘটনাও। প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনার পরে শহর থেকে ট্রাম তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এব্যাপারে সরকারের ট্রাম-নীতি নিয়ে জনস্বার্থ মামলা গড়িয়েছে আদালতে। নতুন বছরের শুরুতেই ওই মামলার চূড়ান্ত শুনানির ওপর নির্ভর করছে কলকাতায় ট্রামের ভবিষ্যৎ।
দেশে প্রথম, কলকাতায় গঙ্গার তলা দিয়ে মেট্রোর উদ্বোধন
ভূগর্ভস্থ মেট্রো রেলের সূচনা হয়েছিল কলকাতাতেই। গত ৬ মার্চ বুধবার সেই মহানগরীতে দেশের প্রথম নদীর তলা দিয়ে মেট্রো রেলপথের সূচনা হল। উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। গঙ্গার উপরের জলস্তর থেকে ৩৩ মিটার নীচে তৈরি হয়েছে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর জোড়া সুড়ঙ্গ। নদীখাতের থেকে আরও ১৩ মিটার গভীরে পলিমাটির ভিতর দিয়ে গিয়েছে সেগুলি। জোড়া সুড়ঙ্গের পেট চিরে ছুটছে ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো পথ।
আবাস প্রকল্পে মমতার উলটো চাল
১০০ দিনের কাজ, আবাস-সহ বিভিন্ন প্রকল্পে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে টাকা আটকে রাখার অভিযোগে সেই ২০২১ সাল থেকে সরব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এর মধ্যে ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল ১১ লক্ষ ৩২ হাজার পরিবারকে পাকা বাড়ি বানানোর জন্য রাজ্য সরকারই টাকা দেবে। সে সময় অনেকেই ভেবেছিলেন, এই প্রতিশ্রুতি স্রেফ কথার কথা। কিন্তু নাহ্, মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে তা বাস্তবায়িত করে বাংলায় নিজের সরকারের ভিত আরও শক্তিশালী করে ফেললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১১ লক্ষ নয়, ডিসেম্বরে ১২ লক্ষ পরিবারকে বাড়ি বানানোর টাকা দিচ্ছে রাজ্য। ২৬ এর মধ্যে আরও ১৬ লক্ষ পরিবারকে বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার ঘোষণাও করেছেন। কোনও একটি রাজ্যের একার পক্ষে এতবড় সামাজিক প্রকল্পের নজির অতীতে বিশেষ নেই বললেই চলে।
বছরভর ঘটনাবহুল সন্দেশখালি
বছরভর খবরের শিরোনামে উত্তর ২৪ পরগনার এই জনপদ। শুরুটা গত ৫ জানুয়ারি, তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানকে গ্রেফতার করতে গিয়ে উন্মত্ত জনতার হাতে প্রহৃত হয়েছিলেন ইডির আধিকারিকরা। প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে পালাতে দেখা গিয়েছিল কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদেরও। ৩৪ দিন পর সেই সন্দেশখালিতেই উলটপুরাণ। শাহজাহানের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন মহিলারা। অভিযোগ, রাতের অন্ধকারে মেয়েদের ডেকে নিয়ে গিয়ে পিঠে তৈরি করানো হত। নারী নির্যাতনের অভিযোগ সামনে আসে।
লোকসভা ভোটে বিরোধীদের প্রধান ইস্যুও হয়ে ওঠে সন্দেশখালি। সন্দেশখালির এক নির্যাতিতাকেই বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রার্থীও করে বিজেপি। চাপের মুখে প্রথমে শাহজাহান পরে তাঁর শাখরেদ উত্তম, শিবুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আদালত থেকে অনুমতি নিয়ে শাহজাহানকে হেফাজতে নেয় ইডি-সিবিআই। এরই মধ্যে বিজেপি নেতা গঙ্গাধর কয়ালের ভিডিও ভাইরাল হয়। যাতে গঙ্গাধরকে বলতে শোনা যায়, সন্দেশখালিতে নাকি কোনও নির্যাতনই হয়নি, সবটাই বিজেপির তৈরি করা প্লট (ভিডিও-র সত্যতা অবশ্য দ্য ওয়াল যাচাই করেনি)। আপাতত, বিতর্কিত বিষয়টি আদালতের বিচারাধিন।
বিচারপতি থেকে রাজনীতিক
নিয়োগ মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়ায় নয়, বিচারপতির চেয়ারে বসে 'ঢাকি সমেত বিসর্সজন দিয়ে দেব'-সহ তাঁর একাধিক মন্তব্য নিয়ে আলোড়নও হয়েছে। তাঁর সিঙ্গল বেঞ্চের একের পর এক রায়ে ডিভিশন বেঞ্চের স্থগিতাদেশ নিয়ে অন্য বিচারপতিদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে গর্জেও উঠেছেন। এ ব্যাপারে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে নালিশও ঠুকেছিলেন। ২৯ বছর হাইকোর্টের অলিন্দে কাটানো এহেন দাপুটে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নিজের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সব মহলকে চমকে দিয়ে গত ৫ মার্চ চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কালো কোর্ট ছেড়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গায়ে চড়িয়ে নেন গেরুয়া জার্সি। তমলুক আসন থেকে লোকসভা ভোটে জিতে তিনি এখন বিজেপি সাংসদ।
ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস, হত-১১
দেশের প্রধান যোগাযোগের মাধ্যম রেল। অথচ সেই রেলেই বেড়ে চলেছে একের পর রেল দুর্ঘটনা। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) বলছে, গত দশ বছরে স্রেফ রেল দুর্ঘটনাতেই প্রাণ হারিয়েছেন আড়াই লক্ষেরও বেশি মানুষ! চলতি বছরের ১৭ জুন। রাজ্যের বুকে সবচেয়ে বড় রেল দুর্ঘটনাটি ঘটে এনজেপির অদূরে নীচবাড়ি এবং রাঙাপানি স্টেশনের মধ্যে। একই লাইনে চলে আসা একটি মালগাড়ি ধাক্কা মারে দাঁড়িয়ে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে।
ট্রেনের পার্সেল ভ্যান মালগাড়ির ইঞ্জিনের ছাদে উঠে যায়। পিছনের কামরাটি একেবারে দুমড়ে মুচড়ে যায়। মৃত্যু হয় ১১ জনের। আহত শতাধিক।
দুটি ট্রেনের সংঘাত এড়াতে 'কবচ' নামক একটি অত্যাধুনিক যন্ত্র প্রতিটি দুরপাল্লার ট্রেনে লাগানো হচ্ছে বলে আগেই জানিয়েছিলেন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণো। দুর্ঘটনার পর সেই 'কবচে'র অস্তিত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অতীতে রেলমন্ত্রী থাকার সময়ে দুর্ঘটনা ঠেকাতে অ্যান্টি কলিউশন ডিভাইস লাগিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। "সেই ডিভাইস কোথায় গেল?" তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মমতাও। অভিযোগ, যাত্রী সুরক্ষা নিয়ে রেলের কোনও মাথাব্যথা নেই।
রাজনীতিতেও বাজিমাত ক্রিকেটের দুই বিশ্বসেরার
২২ গজের মাঠে দু'জনেই দেশের দুই বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য। রাজনীতির মাঠেও তাঁরা যে এভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবেন তা অনেকেই কল্পনা করেননি। সেই সূত্রে এবারের লোকসভা ভোটে বহরমপুর এবং দুর্গাপুরে দুই রাজনীতিকের ইন্দ্রপতনও ঘটেছে বলা যায়।
বহরমপুর, যা কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর খাসতালুক হিসেবে এতদিন পরিচিত ছিল, লোকসভা নামক ভোটে খেলতে নেমে সেই অধীরকেই ৬৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন তৃণমূলের ইউসুফ পাঠান। বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বরাবরই বলতেন, 'হেরো রেকর্ড আমার নেই'। এবারের লোকসভা ভোটে সেই দুর্গাপুর পূর্ব লোকসভা কেন্দ্রে দিলীপকে প্রায় এক লাখ চল্লিশ হাজার ভোটের ব্যবধানে গো হারান হারিয়ে শেষ হাসি হেসেছেন তৃণমূলের কীর্তি আজাদ।
না ফেরার দেশে বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী
একসময় তিনি ছিলেন চেইন্স স্মোকার। সেই সূত্রে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা ছিলই। ২০২১ সালের মে মাসে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে চলতি বছরের ৮ অগস্ট সকালে পাম অ্যাভিনিউয়ের ছোট্ট দু'কামরার ফ্ল্যাটেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, সিপিএম নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
২০০০ থেকে ২০১১ সাল, টানা ১১ বছর রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের পদ সামলেছেন তিনি। শিল্প স্থাপনের লক্ষ্যে জমি অধিগ্রহণকে ঘিরে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে প্রশ্নের মুখে পড়েছিল তাঁর সরকার। ২০০৮-১১, তাঁর আমলেই জঙ্গলমহলে মাথা চাড়া দিয়েছিল মাওবাদীরা। অবশেষে ২০১১ সালে পালাবদল। ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর কিছুদিন রাজ্য–রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। পার্টি অফিসে একদিন নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর থেকে ক্রমশঃ সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান।