শেষ আপডেট: 5th June 2023 08:35
দ্য ওয়াল ব্যুরো: 'একটুকু ছোঁয়া লাগে'...ছুঁলেই শিহরিত হয় গাছ। স্পর্শে চঞ্চল হয়।
গাছেরও (Plants) প্রাণ আছে। ছোট থেকেই এই কথাটা শুনে বড় হয়েছি আমরা। শুধু প্রাণ নয়। গাছের কিন্তু নিজের ইচ্ছেও আছে। গাছের শব্দ, গাছের কান্না শুনেছিলেন বিজ্ঞানীরা। গাছের যে অনুভূতি আছে তাও এবার প্রমাণ হল। স্পর্শের অনুভূতি বুঝতে পারে গাছ, তাতে সাড়াও দেয়। খারাপ ও ভাল স্পর্শের তফাৎও করতে পারে। আশ্চর্য খোঁজ পেলেন বিজ্ঞানীরা।
লজ্জাবতী (Mimosa) লতার কথা তো আমরা সবাই জানি। একটু ছুঁলেই কুঁকড়ে যায়। যেন লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। লজ্জাবতী গাছের কোষের সেন্সর স্পর্শের অনুভূতি বুঝতে পারে। তাই সামান্য স্পর্শেই বদলটা লক্ষ্য করা যায়। ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির ( Washington State University) গবেষকরা বলছেন, সব গাছেরই স্পর্শের অনুভূতি আছে। কিছু প্রজাতির উদ্ভিদ বেশি স্পর্শকাতর, বাকিরা কম। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীরই মতো।
ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির বায়োসায়েন্সের অধ্যাপক মাইকেল নোব্লক বলছেন, গাছের স্নায়ুতন্ত্র নেই, কিন্তু তাও আশ্চর্যজনকভাবে স্পর্শের অনুভূতি বুঝতে পারে উদ্ভিদরা। গাছের পাতা, কাণ্ডের কোষ এতটাই সেনসিটিভ যে বাইরের স্পর্শ সহজেই বুঝে যায়। সেই স্পর্শে সাড়াও দেয়। স্পর্শের ধরন বুঝে কে মিত্র আর কে বন্ধু, সেটাও নাকি আলাদা করে বুঝতে পারে উদ্ভিদরা।
আরও পড়ুন: গাছের কান্না শুনলেন বিজ্ঞানীরা! যন্ত্রণা-অবহেলায় তীব্র আর্তনাদ করে
'নেচার প্ল্যান্ট' বিজ্ঞানপত্রিকায় এই গবষণার খবর প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক-গবেষক মাইকেল বলছেন, ১২ প্রজাতির গাছ নিয়ে ৮৪ রকমভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছিল। সবকটিতে দেখা গেছে, উদ্ভিদের স্পর্শে সাড়া দিচ্ছে। পরীক্ষার জন্য কাচের তৈরি খুব সূক্ষ্ম রড নিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। এটি একরকম মাইক্রো-ক্যান্টিলিভার (micro-cantilever) যা মানুষের চুলের থেকেও বেশি সূক্ষ্ম। এই রড নিয়ে গাছের পাতা, কাণ্ডে নানাভাবে স্পর্শ করেন বিজ্ঞানীরা। এরপর গাছের ওই অংশের কোষ নিয়ে মাইক্রোস্কোপের নীচে পরীক্ষা করেন।
বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে দেখেন, পাতা বা কাণ্ডের যে অংশে স্পর্শ করা হয়েছে সেখানকার কোষগুলো উদ্দীপিত হয়ে উঠেছে। সেই স্পর্শের অনুভূতি তরঙ্গের মাধ্যমে গাছের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। স্পর্শের ধরন যেমন, উদ্দীপনাও তেমন। বিজ্ঞানীরা সূক্ষ্ম রড দিয়ে নানাভাবে খোঁচা দিয়ে, জোরে চাপ দিয়ে পরীক্ষা করেন। দেখেন, স্পর্শের চাপ যত বাড়ছে, কোষের উদ্দীপনাও ততই বাড়ছে। সেই সঙ্গে ক্যালসিয়ামের তরঙ্গ বইছে গাছের সারা শরীরে।
ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলা যাক। মানুষ স্পর্শের অনুভূতি পায় স্নায়ুর মাধ্যমে। স্নায়ুর তরঙ্গ প্রবাহিত হয় সারা শরীরে। এক স্নায়ু থেকে অনুভূতি অন্য স্নায়ুতে যায় রাসায়নিক সঙ্কেতের মাধ্যমে। গাছের স্নায়ু নেই। তাই স্পর্শের অনুভূতি ক্যালসিয়াম তরঙ্গের (Calcium signal or Calcium Waves) মাধ্যমে গাছের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
গাছ যে স্পর্শ বোঝে সে নিয়ে আগেও একবার গবেষণা হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছিলেন, শুঁয়োপোকা বা অন্যান্য পোকা যখন গাছের পাতা খায় তখন তাদের কামড় বুঝতে পারে গাছের কোষ। পাতার কোষে সেই অনুভূতি এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে গাছের নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, অনেকটা মানুষের ইমিউন সিস্টেমের (Immunity) মতো। গাছ তখন এমন রস নিঃসরণ করে যাতে কচি পাতাও তেতো লাগে। অর্থাৎ পোকা থেকে বাঁচার জন্য পাতার স্বাদে বদল আনতে পারে গাছেরা। গাছের 'ডিফেন্স সিস্টেম' নিয়ে সেই গবেষণাও বেশ হইচই ফেলেছিল সে সময়। এবার বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করলেন, গাছ খারাপ ও ভাল স্পর্শের মতো পার্থক্য করতে পারে। স্পর্শে তাদের অনুভূতিও সক্রিয় হয়ে ওঠে।
আচার্য জগদীশচন্দ্র ও তাঁর বন্ধু আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার জনক। জগদীশচন্দ্র বসু সেই কবেই বলে গিয়েছিলেন গাছেরও অনুভূতি আছে। তাঁর দুটি অসাধারণ নিবন্ধ ‘গাছের কথা’ ও ‘উদ্ভিদের জন্ম মৃত্যু’। এর পর একই বিষয়ে লেখেন ‘নির্বাক জীবন’। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ও গবেষণাধর্মী লেখাটি সহজ বাংলায় লেখা ‘আহত উদ্ভিদ'। এই সমস্ত নিবন্ধে খুব পরিষ্কার ভাবে ‘উদ্ভিদের প্রাণ আছে’ এ কথা আচার্য প্রমাণ করেছেন ও বলেছেন। মূল বক্তব্য: উদ্ভিদের জন্ম, বৃদ্ধি, বংশবিস্তার, মৃত্যু, ভয়-ব্যথা-আনন্দ অনুভবের ক্ষমতা আছে, এমনকি অন্য উদ্ভিদ ও প্রাণের প্রতি সমব্যথী হওয়ার ক্ষমতাও আছে। এগুলিই প্রাণের লক্ষণ। বিজ্ঞানীরা এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি যন্ত্রে গাছের যন্ত্রণার শব্দ শুনেছেন। এবার বুঝলেন গাছের অনুভূতিও ততটাই প্রখর।