মুর্ছা পাহাড়ের তোপধ্বনি
শেষ আপডেট: 1st October 2024 13:28
দ্য ওয়াল ব্যুরো, বাঁকুড়া: সাত সকালে মল্লভূমে মুহুর্মূহু কামানের গর্জন! সঙ্গে ভেসে ঢোল, কাঁসর, সানাইয়ের সুর! কোনও যুদ্ধ পরিস্থিতি নয়, বৃহস্পতিবার স্নান পর্ব সেরে মন্দিরে এলেন বড় ঠাকুরাণী। পুজোর শুরু ১৩ দিন আগেই দেবীর আগমন ঘটল এখানে। এদিন থেকেই ১৭ দিন চলবে পুজো।
বাংলার প্রাচীন দুর্গাপুজাগুলির মধ্যে অন্যতম বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ কূলদেবী মৃন্ময়ীর পুজো। এই পুজো ১ হাজার ২৮ বছরের পুরনো। কথিত আছে, ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা জগৎমল্ল এই পুজোর সূচনা করেন। মল্লরাজাদের রাজপাঠ অনেকদিন আগেই শেষ হয়েছে। ভাঙাচোরা রাজবাড়ির দেওয়ালে কান পাতলে আজও শোনা যায় মল্লরাজাদের প্রাচীন ইতিহাস।
এদিন নবম্যাদি কল্প থেকে বড় ঠাকুরাণী অর্থাৎ দেবী দশমস্কন্ধ কালী (যিনি শুম্ভ নিশুম্ভকে বধ করেছিলেন) পুজো শুরু হল। সকালে রাজবাড়ি সংলগ্ন রঘুনাথ সায়ের এ বড়ঠাকুরাণীর পটের স্নান পর্ব শেষে মন্দিরে প্রবেশ করেন। পরে প্রথানুযায়ী তিনবার মূর্চ্ছা পাহাড়ে কামানের তোপধ্বনি দেওয়া হয়। পরে গর্ভগৃহে প্রবেশের মুহূর্তেও তিনবার তোপধ্বনি দেওয়া হয়। পরে দেবীকে অন্নভোগ নিবেদনের সময় আরও তিনবার কামানের তোপধ্বনি দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে বড় ঠাকুরাণীর পুজোর দিন থেকেই মল্ল রাজাদের প্রাচীন এই রাজধানীতে শারদোৎসবের সূচনা হয়ে গেল।
'পট পুজো'ই এখানকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শহরের শাঁখারি বাজারের ফৌজদার পরিবারের সদস্যরা ধারাবাহিক ভাবে মেনে আজও বড় ঠাকুরাণী, মেজ ঠাকুরাণী ও ছোটো ঠাকুরাণীর আলাদা-আলাদা তিনটি পট আঁকেন। মন্দিরে দেবী মৃন্ময়ী প্রতিমার পাশেই নির্দিষ্ট জায়গায় এই তিনটি পট রেখে পুজো হয়। দেবী পক্ষের চতুর্থীর দিন থেকে রাজপরিবারের মেজ ঠাকররাণী অর্থাৎ দেবী মহালক্ষ্মী পুজো হয়। সপ্তমীর দিন থেকে ছোটো ঠাকুররাণী অর্থাৎ দেবী মহাসরস্বতীর পুজোর আয়োজন করা হয়। বড়, মেজো ও ছোটো ঠাকুরাণী এই তিনজনকেই দেবী মহামায়ার রূপে মল্লরাজাদের হস্ত লিখিত বলিনারায়নী পুথি অনুযায়ী পূজিতা হন।
একসময় মল্ল রাজত্বের রাজধানী ছিল জয়পুরের প্রদ্যুম্নপুরে। লোকমুখে প্রচলিত আছে, একবার এই মুর্ছা পাহাড়েই ক্লান্ত হয়ে রাজা একটি বট গাছের নীচে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সেই সময়ে তাঁর সঙ্গে অলৌকিক কাণ্ড ঘটতে থাকে। তার দেবী মৃন্ময়ী জগৎমল্লকে দেখা দেন। তাঁকে বিষ্ণুপুরে মৃন্ময়ীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে পুজোর নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে বিষ্ণুপুরে রাজধানী স্থানান্তরিত করে রাজত্ব করার নির্দেশ দেন। দেবীর নির্দেশ মতো এরপরই মল্ল রাজধানী স্থানান্তরিত হয়। রাজ প্রাসাদ লাগোয়া বিশাল মৃন্ময়ী মন্দির তৈরি করে শুরু হয় দেবীর আরাধনা।
মল্লরাজা সমকালীন রাজাদের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন। বৈভব আর আভিজাত্যের ছোঁয়া লাগে মৃন্ময়ীর পুজোতেও। রাজার পুজো। তাই তার আচার, সংস্কারও আলাদা। পুজোর পনেরো দিন আগে জীতাষ্টমীর পরের দিন নবমী তিথিতে শুরু হয় দেবীর পুজো। কালের নিয়মে মল্ল রাজত্ব ও রাজারা হারিয়ে গেলেও অতীতের সেই নিয়ম নিষ্ঠা আজো অটুট মৃন্ময়ীর পুজোয়।