শেষ আপডেট: 8th September 2024 09:08
অমল সরকার
নয়ের দশের গোড়ায় বঙ্গ-রাজনীতি তোলপাড় হয়েছিল ক্যানিংয়ের এক দিন মজুর মহিলাকে ধর্ষণের অভিযোগ ঘিরে। সেই ঘটনায় প্রতিবাদের প্রথমসারিতে ছিলেন যুব কংগ্রেসের তৎকালীন নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ধর্ষণ তখন আজকের মতো পথ দুর্ঘটনা জাতীয় নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে ওঠেনি। জনস্বার্থ মামলা, সিবিআই তদন্ত, ডিএনএ টেস্ট, এসবের বালাই ছিল না।
তৃণমূল প্রতি বছর ২১ জুলাইয়ে শহিদ দিবস পালন করে। ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাইয়ের রাইটার্স বিল্ডিংস অভিযানের আগে সে বছর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আরও একটি ঘটনা সাড়া ফেলেছিল। দিনটা ছিল ৭ জানুয়ারি। নদিয়ার এক মহিলাকে নিয়ে রাইটার্সে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ঘরের সামনে বসে পড়েছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, আজকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নদিয়ার মহিলার কিশোরী কন্যা ধর্ষণের ফলে অন্তঃস্বত্তা হয়ে পড়েছিল। তিনি বিচার চাইতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হয়েছিলেন।
বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে আসা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে জ্যোতি বসু সেদিন দেখা করেননি। আমি আগেও লিখেছি, আবারও বলছি, কাজটা জ্যোতিবাবু সেদিন ঠিক করেননি। হয়তো পুলিশ তাঁকে রিপোর্ট দিয়েছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নদিয়ার মহিলাকে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর চেম্বারেই ধর্ণায় বসে জ্যোতিবাবুকে আটকে দেবেন।
সেদিন বেশি রাতে পুলিশ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মমতাকে চ্যাংদোলা করে তুলে লালবাজারে নিয়ে গিয়ে কাগজপত্র লেখালেখির পর ছেড়ে দেয়। লালবাজার থেকে মাঝরাতে বাড়ি ফেরেন মমতা। রাত দখলের আন্দোলনের কোনও ধারণা তখন ছিল না। আমি নিশ্চিত, থাকলে সেই রাতই দখলের ডাক দিতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সিঙ্গুরের জমি উদ্ধারে ধর্মতলায় অনশন আন্দোলন। ফাইল ছবি।
তাঁর চরিত্রের এই প্রতিবাদী দিকটি কারও অজানা নয়। ১৪ অগাস্ট রাত দখলের আন্দোলনের দিন বিকালে বন্ধুদের আাড্ডায় একজন জানতে চাইলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ রাতে কী করতে পারেন? তৃণমূল নেত্রীর অতীতকে বিবেচনায় রেখে আমি দৃঢতার সঙ্গে বলেছিলাম, মুখ্যমন্ত্রী নিজেই শহরের কোথাও আন্দোলনে শামিল হবেন। এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে মোটেই অপ্রত্যাশীত নয়। তাছাড়া, সেই আন্দোলনের আহ্বায়ক প্রেসিডেন্সির ছাত্রী রিমঝিম সিনহা লিঙ্গ বৈষম্য, পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ দাবি করেননি।
আমরা অনেকেই সেই প্রতিবাদী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেছি। আজকাল যেমন ঘটনা, দুর্ঘটনা, মারামারি, কাটাকাটি শুরু হলে লোকে পুলিশে খবর দেওয়ার আগে মোবাইলে ভিডিও করে, একটা সময় এমন পরিস্থিতিতে অসহায় মানুষকে বলতে শুনেছি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করো। সেই সব দিনে বহু মানুষ চুপিসাড়ে মমতার ফোন নম্বর জোগার করে দেওয়ার অনুরোধ করেছেন।
সিপিএম জমানায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধী নেত্রী হিসাবে নির্মাণের একটা পর্বে মানুষ, বিশেষ করে গরিব মধ্যবিত্ত অংশ তাঁকে ত্রাতা মনে করত। বিশ্বাস করত, সমস্যার কথা একবার মমতার কানে পৌঁছে দেওয়া গেলে সুরাহা মিলবে। ঘন ঘন লোডশেডিং, পুরসভার কলে জল না আসা, মারামারি, কাটাকাটির ঘটনায় অনেককে দেখেছি পুলিশ-সরকারি কর্মীর উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, এভাবে চললে এরপর মমতাকে খবর দেব। তখন বুঝবেন কত ধানে কত চাল। সিপিএম জমানায় পুলিশ-প্রশাসনকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে যে ঝক্কি সামলাকে হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বিগত তেরো বছর তাঁর পুলিশকে তেমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি।
সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরজি কর হাসপাতালের অকল্পনীয় ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় নজিরবিহীন জন-বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন। ২০১১-তে ৩৪ বছরের সিপিএম শাসনের অপসান ঘটিয়ে তাঁর ক্ষমতা দখল প্রথমসারির আন্তর্জাতিক মিডিয়ার খবর হয়েছে। আরজি কর সেই কভারেজকে ছাপিয়ে গিয়েছে। যে আন্দোলনে দলীয় ঝাণ্ডা নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক ঝাণ্ডার পরিবর্তে জাতীয় পতাকা হাতে আন্দোলনের নয়া প্রবণতার সাফল্যের হার তুলনামূলকভাবে বেশি, যা সব রাজনৈতিক দলকেই চিন্তায় ফেলেছে।
তাছাড়া, বিশ-পঁচিশ বছর অগের মতো মানুষ ভোট কোনও দলের জন্য পাকাপাকি গচ্ছিত রাখে না। বেশি লাভের আশায় শেয়ারে কিংবা ব্যাঙ্কের নতুন নতুন স্কিমে টাকা জমানোর মতো মানুষ নির্বাচনকালীন নানা পরিস্থিতি এবং অঙ্ক বিবেচনায় রেখে ভোট দেয়। নইলে বামের ভোট রামের বাক্সে গেল কী করে?
৭ জানুয়ারি, ১৯৯৩। রাইটার্সে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ঘরের বাইরে থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ২০ মে, ২০১১। সেই ঘরে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
আমি ইতিপূর্বে লিখেছি, বাংলায় গত লোকসভা নির্বাচন যতটা মোদীর প্রতি অনাস্থা, ততটাই তা ছিল লক্ষ্ণীর ভাণ্ডারের ভোট। তাই বলে তৃণমূলকে ২৯টি আসনে জিতিয়ে দেওয়া মানুষ এই দলের একাংশের অনাচার, অবিচার, প্রশাসনের একাংশের অনিয়ম চোখু বুঁজে মেনে নেবে, নিশ্চয়ই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তা মনে করেন না। তাই লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের পর বিজয় উৎসব করার আগে তিনি দলকে শাসন করেছেন।
লক্ষ্মীর ভাণ্ডার-সহ তৃণমূল সরকারের ১১টি কল্যাণ প্রকল্প প্রশংসনীয় উদ্যোগ। যদিও সেই সব প্রকল্পের সুবিধা পেতে গিয়ে বহু জায়গায় গরিব মানুষকে শাসক দলের স্থানীয় নেতাকে প্রভূ মানতে হচ্ছে। তারপরও বিপদ-আপদে পাশে থাকাটাই গরিব মানুষের তৃণমূল সরকারের প্রতি আস্থার কারণ। লোকসভা ভোটের সময় মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার এক দিনমজুর ভদ্রলোক লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নিয়ে প্রতিবেশীদের সাক্ষী রেখে আমাকে বলেছিলেন, ‘কত সরকার এল গেল, দিদির আগে কেউ তো এভাবে ভাবেনি। আমার স্ত্রী, ভাইয়ের বউ এবং বিধবা বোন মিলিয়ে আমরা মাসে তিন হাজার টাকা পাই। ওই টাকা আমাদের কাছে তিরিশ হাজারের সমান।’ ক’দিন আগে স্থানীয় সাংবাদিক বন্ধু ফোনে জানালেন, বেলডাঙা শহরের গলির সেই মানুষও রাত দখলের আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন।
মিডিয়ার একাংশ প্রশ্ন তুলছে, আরজি কর নিয়ে আন্দোলনের আয়ু কতদিন। কেউ কেউ মনে করছেন, বিশ্বকর্মা পুজোর আগেই আন্দোলন থেমে যাবে। আমি এই নিশ্চিত নই। তাছাড়া, আন্দোলন থেমে যাওয়া মানে কি প্রতিবাদ থমকে যাওয়া?
আমার মনে হয়, আরজি করের আন্দোলন ঘিরে নতুন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যা প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন ও ভবিষ্যতে ক্ষমতা প্রত্যাশী সব দলকেই মাথায় রাখতে হবে। এটাই আন্দোলনের আগামীর প্রবণতা বলে আমার ধারণা। তাহল, শুধু চোর ধরলেই হবে না, চুরি ঠেকাতে না পারা বা সময় মতো চোরকে পাকড়াও করতে না পারার দায়ে পুলিশ-প্রশাসনকে কাঠগড়ায় তুলতে হবে, আরজি করের আন্দোলনের মূল বার্তা সেটাই।
এখন চলমান আন্দোলনের দাবি দুটি, এক. ধর্ষক-খুনি এক নাকি জাত-ধর্ম-দলিয় আনুগত্য নির্বিশেষে তাদের পরিচয় প্রকাশ এবং অপরাধের ঘটনাস্থল নিয়ে যুক্তিযুক্ত, তথ্যপ্রমাণ-পুষ্ট তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ। সেই কাজ সিবিআইয়ের। সোমবার সুপ্রিম কোর্টে সিবিআই-কে এই জন-চাহিদার কথা মাথায় রেখে নিজেদের বক্তব্য পেশ করতে হবে। দেশবাসী জানতে আগ্রহী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আরজি কর মামলার বিচারের দায়িত্ব নেওয়া প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় কী ভূমিকা নেন। আরজি কর আন্দোলনের সেটাও এক বৈশিষ্ট্য। বিচার না পেলে মানুষ আদালতকেও কাঠগড়ায় তুলবেন।
দুই, অপরাধ পরবর্তী সময়ে পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের মান্যতা এবং সাজা। আমার মতে, ঘটনাস্থল আরজি করেই শিক্ষার্থী চিকিৎসকের দেহের ময়না তদন্ত প্রশাসনের সবচেয়ে বড় ভুল। অন্য হাসপাতালে তা করিয়ে তদন্তে স্বচ্ছতা বজায় রাখার বার্তা দেওয়া যেত। অবাক হলাম, বিজেপি নেতারাও অন্যত্র ময়না তদন্তের দাবি তোলেননি। অথচ তাঁরাই রায়গঞ্জে দলীয় কর্মী খুনে চারবার ময়না তদন্ত করিয়েছেন আইনি লড়াই করে।
তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয়, তথ্য-প্রমাণ লোপাটে পুলিশের কোনও প্রচেষ্টা ছিল না, তারপরও বলতে হয়, সেমিনার হল এবং লাগোয়া এলাকায় অনিয়ন্ত্রিত ভিড়, বহিরাগতের প্রবেশ না আটকানো পুলিশের মস্ত বড় গাফিলতি। দীর্ঘদিন সিআইডির উঁচু পদে থাকা, কামদুনির ঘটনার তদন্তের পর্যবেক্ষক পুলিশ কমিশনার-সহ লালবাজারের পদস্থ কর্তাদের মাথায় এই গাফিলতি নজরে এল না? ময়না তদন্তের পর এফআইআর দায়ের মতো অবাক করা ঘটনাও যদি ষড়যন্ত্র, পুলিশের পরিকল্পিত পদক্ষেপ না হয়ে থাকে, এই অবাক করা কাণ্ড-সহ যাবতীয় ভুল, গাফিলতির দায় তো কাউকে না কাউকে নিতে হবে। দায় পুলিশ-প্রশাসনের উপর মহলকেই নিতে হয়। ওসি, এসিদের সাসপেন্ড করে দায় সেরে আসলে নিচুতলার মনোবল নষ্ট করা হয়। কারও কারও বক্তব্য, পুলিশের গাফিলতিকে বড় করে দেখানো হচ্ছে। মনে রাখা দরকার, পুলিশের ভুল যদি ভগ্নাংশ শতাংশও হয়ে থাকে, সেই শিক্ষার্থী-চিকিৎসকের পরিবারের ক্ষতি একশো শতাংশ। বেতনভুক কর্মচারীর ভুলের দায় সরকার নিজের কাঁধে কেন বইছে, এটা গুরুতর মৌলিক প্রশ্ন।
আন্দোলনের দাবি পূরণ একটা মর্যাদা, স্বীকৃতি। এই ব্যাপারেও দৃষ্টান্ত মমতার সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন। কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, আরজি কর কাণ্ডে দাবি পূরণ না হলে কী হবে? কতদিন মানুষ রাত জাগবে?
এই ব্যাপারে তর্ক অনর্থক। হয়তো কোনও না কোনও কারণে আন্দোলন থেমে যাবে। তাতে দাবি উবে যাবে কি? দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ সহজে আপস করে না। রিজওয়ানুর রহমানের রহস্য মৃত্যুর ঘটনায় তৎকালীন পুলিশ কমিশনারকে একটি ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্যের জন্য গদি হারাতে হয়েছিল।
আরজি করের মতো মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, যেখানে সূর্যাস্তের বালাই নেই, ৩৬৫দিন, ২৪ ঘণ্টা আলো ঝলমল সচল একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী-চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় আরও সংবেদনশীলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেই পারত পুলিশ ও প্রশাসন।
সবশেষে বলি, তৃণমূলের যে নেতা মন্ত্রীরা প্রতিবাদীদের হুমকি দিচ্ছেন তাঁদের বলব, একবার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাগুলি মনোযোগ দিয়ে শুনুন। আরজি কর কাণ্ডেই সংবেদনশীলতার যে নজির গড়েছেন তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক, সব শাসক দলেই তা এখন বিরল। আন্দোলনের ইস্যু এবং আন্দোলনকারী, দুই ব্যাপারেই তাঁর মার্জিত মন্তব্য প্রশংসনীয়। তিনি চিকিৎসকদেরও আন্দোলন বন্ধ করতে বলেননি। পরামর্শ দিয়েছেন, পালা করে আন্দোলন করতে, যাতে চিকিৎসা বিঘ্নিত না হয়।