শেষ আপডেট: 22nd September 2023 17:06
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বছর বছর ফিরে আসছে নিপা ভাইরাস (Nipah Virus)। কোভিডের মতোই সংক্রামক ভাইরাস যার বাহক বাদুড়। কেরলে বারে বারেই হানা দেয় নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ। মৃত্যু হয়। এখন শুধু কেরল নয়, বাংলাতেও এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়েছে। ২০০১ সাল থেকে প্রায় প্রতি বছরই বাংলার বিভিন্ন জেলায় একটা দুটো করে নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর খোঁজ মেলে।
নিপা ভাইরাসকে (Nipah Virus) বলে জুনটিক ভাইরাস (Zoonotic Virus), অর্থাৎ পশুর থেকে মানুষের শরীরে ছড়াতে পারে। এই ভাইরাসের বাহক ফ্লাইং ফক্স (বৈজ্ঞানিক নাম পিটারোপাস মিডিয়াস) নামে একধরনের ফলভোজী বাদুড়। বাদুড় থেকে কুকুর, বিড়াল, ছাগল, ঘোড়া বা ভেড়ার শরীরে মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। আক্রান্ত পশুদের দেহের অবশিষ্টাংশ, বা মলমূত্র থেকে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। করোনার মতোও নিপাও আরএনএ ভাইরাস।
অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্স (এইমস), আইসিএমআর জানাচ্ছে, নিপা ভাইরাস (Nipah Virus) আক্রান্ত হলে কোনও নির্দিষ্ট ওষুধ নেই, আক্রমণ প্রতিরোধ করার মতো কোনও টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে মৃত্যুর হার বিশ্বে গড়ে প্রায় ৭৫ শতাংশ।
২০০১ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে নিপা ভাইরাসের (Nipah Virus) সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। ৬৬ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছিল। স্বাস্থ্য দফতর জানিয়েছিল, সংক্রমণে মৃত্যুহার ৩ শতাংশের বেশি। মাঝের কয়েকটা বছর নিপার আতঙ্ক সেভাবে ছড়ায়নি। ২০০৭ সালে ফের নিপা ফিরে আসে ভারতে। বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন নদিয়াতে ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ে।
পুণের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির বিশেষজ্ঞরা উত্তরবঙ্গ ও ধুবুরি থেকে ফল খাওয়া বাদুড়ের ১০৭টি নমুনা সংগ্রহ করেছিল ২০১৫ সালে। কোচবিহারে ৩৯টি নমুনার মধ্যে ৬টি ও ধুবুরিতে সংগ্রহ করা ৬০টি নমুনার মধ্যে ৩টি বাদুড়ের নমুনায় মিলেছে নিপা ভাইরাস চিহ্নিত করা গিয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, ধুবুরি ও কোচবিহারে জনবসতি অঞ্চলে প্রচুর বাদুড় আছে। তাদের মধ্যে নিপা পজিটিভ বাদুড় থাকায় সেখানকার মানুষজনের মধ্যে সংক্রমণ বেশিমাত্রায় ছড়িয়েছিল। ২০০১ ও ২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি ও নদিয়ায় নিপা সংক্রমণে ৪৭ জনের প্রাণ গিয়েছিল।
২০০১ সালে বাংলাদেশেও নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়েছিল সাঙ্ঘাতিকভাবে। এর পর ২০০৩, ২০০৪, ২০০৫ থেকে ২০১১ সাল অবধি— প্রতি বছরই নিয়ম করে বাংলাদেশে এই ভাইরাস বিভীষিকা ছড়িয়েছে৷ ২০১৮ সালের মে-জুন মাস নাগাদ করোনার মতোই নিপা ভাইরাসের (Nipah Virus) সংক্রমণ নিয়েও হইচই শুরু হয় দেশে। কেরলের কোঝিকোড়ে ভাইরাস আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করে। ১৮ জনের শরীরে ভাইরাসের জিন খুঁজে পাওয়া যায়, মৃত্যু হয় অন্তত ১৭ জনের। প্রায় তিন হাজার জনকে আইসোলেশনে রাখা হয়। আক্রান্ত ও মৃতদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে নমুনা সংগ্রহ করে কনট্যাক্ট ট্রেসিং করেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। একজনের থেকে কতজনের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়েছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা হয়।
২০১৯ সালেও কেরলে নিপা ভাইরাস (Nipah Virus) আক্রান্তের খোঁজ মেলে। তারপরে করোনা সংক্রমণ কালে নিপা নিয়ে সচেতনতার প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। এখন ফের এই ভাইরাস মাথাচাড়া দিয়েছে বলে খবর।
প্রথমে সাধারণ জ্বরই হয় রোগীর। এরপর শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে। মাথাব্যথা, বমি শুরু হয়। মাথায় পৌঁছে যায় সংক্রমণের রেশ। শুরু হয় খিঁচুনি। গলা ব্যথা, তীব্র শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকে রোগী। বাড়াবাড়ি সংক্রমণে ২৪–৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রোগী কোমা স্টেজে চলে যেতে পারে।
মস্তিষ্কের প্রদাহ শুরু হয়, হৃদপেশিতেও প্রদাহ হয় অনেকের। এনসেফ্যালাইটিস ও মায়োকার্ডিটিসে আক্রান্ত হয় রোগী। আক্রান্ত মানুষকে দ্রুত এমন হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, যেখানে রোগীকে সবার থেকে আলাদা রাখার ও ইনটেনসিভ সাপোর্টিভ কেয়ারের ব্যবস্থা আছে।
সাধারণ পরীক্ষায় নিপার সংক্রমণ ধরা পড়ে না৷ থ্রোট সোয়াব, অর্থাৎ গলা থেকে তরল নিয়ে রিয়েল টাইম পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন বা আরটি-পিসিআর পরীক্ষা করে সংক্রমণ ধরতে হয়। কোভিডের মতোই আরএনএ ভাইরাস শণাক্ত করার জন্য আরটি-পিসিআর পরীক্ষাই সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য। শিরদাঁড়ার তরল, ইউরিন ও রক্ত পরীক্ষাও করার ডাক্তাররা৷ ক্ষেত্রবিশেষে আইজিজি ও আইজিএম অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করেও দেখা হয়।
নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ হলে তার সঠিক কোনও চিকিৎসা পদ্ধতি এখনও বের হয়নি। ভ্যাকসিনও নেই। ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার ৩–১৪ দিনের মধ্যে উপসর্গ শুরু হয়৷
নিপা থেকে বাঁচতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দিতে বলছেন ডাক্তাররা। বাজার থেকে কিনে আসা মাংস ভাল করে ধুয়ে বেশি আঁচে রান্না করে খাওয়াই ভাল। নাকে–মুখে হাত দেওয়ার আগে বা খাবার খাওয়ার আগে হাত ভাল করে ধুয়ে নেওয়া, আক্রান্ত রোগীর থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব রাখা জরুরি। এক্ষেত্রেও মাস্ক পরার দিকে জোর দেন ডাক্তাররা, এন৯৫ মাস্ক পরে নিলে বিপদের আশঙ্কা কম থাকে৷
আরও পড়ুন: ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া বাড়ছে, রোগীদের চিকিৎসা করতে সন্ধেবেলাও খোলা থাকবে সরকারি আউটডোর