বেলা তখন দশটা পেরিয়েছে সবে। উপচে পড়ছে ডানকুনি কোল কমপ্লেক্স। শ’তিনেক চেয়ার পাতা। তাতে এসে বসে পড়েছেন স্থানীয় মেয়ে-বউরা। কেউ আবার ছেলে-মেয়েকে আগে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন জায়গা রাখার জন্য। সিনেমার ‘ভিলেন’কে একবার চাক্ষুষ করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি কেউ। সিপিএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই-এর নেতারাও আগাম আন্দাজ করেছিলেন। তাই নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানের আগে নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন। সেখানেই ডানকুনির জনতা দেখল এমন একজন মানুষকে যিনি রিল লাইফের ভিলেন হলেও রিয়েল লাইফে একজন ছাপোষা মানুষ।
ঘড়ির কাঁটায় তখন সওয়া দশটা। একটা কালো টয়োটা গাড়ি এসে থামল কোল কমপ্লেক্সের উঠোনে। লিনেনের ধবধবে সাদা কুর্তা, ডেনিম ব্লু জিনস্, পায়ে ব্ল্যাক লেদারের স্নিকার্স। গাড়ি থেকে নামলেন ছ’ফুট উচ্চতার, তাগড়া চেহারার ভদ্রলোক। ঝাঁপিয়ে পড়ল জনতা। স্বেচ্ছাসেবকরা আটকানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু স্বয়ং প্রকাশ রাজই আটকালেন না। সবার সঙ্গে হাত মেলালেন, সেলফির আবদার মেটালেন। তারপর নাগরিক সংবর্ধনার মঞ্চে উঠলেন।
নাগরিক সংবর্ধনা আর ডিওয়াইএফআই-এর রাজ্য সম্মেলনের উদ্বোধনের মাঝে কোল কমপ্লেক্সের গেস্টহাউসে
‘দ্য ওয়াল’-এর সাংবাদিক
শোভন চক্রবর্তীকে খোলামেলা সাক্ষাৎকার দিলেন প্রকাশ রাজ।
প্রশ্ন: চার বছর নরেন্দ্র মোদীর সরকার চালাচ্ছেন। আরেকটা সাধারণ নির্বাচন দোরগোড়ায়। কী অভিমত আপনার?
প্রকাশ: বিজেপি গণতন্ত্রের জন্য খুব একটা ভাল নয়। তাদের শরীরী ভাষা, কাজ-কম্ম সব দিয়েই এটা গত চার বছরে মানুষের সামনে প্রকাশ হয়ে গেছে। আমাদের দেশের গণতন্ত্রের একটা অন্য মানে আছে। একটা ভাষা, একটা ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া কোনও গণতান্ত্রিক মানসিকতার লক্ষণ নয়।
প্রশ্ন: বিজেপি-র বিরুদ্ধে আপনার মতামতকে তুলে ধরতে সরাসরি কোনও রাজনৈতিক শিবিরে দেখা যাবে আপনাকে?
প্রকাশ: প্রথমে বুঝে রাখা ভাল, আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশ কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন। তাঁদের মতামতের কোনও দাম নেই? আমিও আমার মতো করে আমার কথা মানুষের কাছে তুলে ধরব।
প্রশ্ন: সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ হত্যার পর থেকেই মোদী সরকারের বিরুদ্ধে আপনি সরব...
প্রকাশ: প্রতিটা সরকারকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দেখতে হয়। এই সরকার তো মানুষের ভোটেই নির্বাচিত। হিন্দু বা মুসলমান নয়। ভারতের নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত। কিন্তু একটা সময়ের পর বোঝা গেল সরকার যা ইচ্ছে তাই করছে। ভোটে জেতা মানে তো যা ইচ্ছে তাই করতে পারে না।
প্রশ্ন: বিজেপি বিরোধী প্রায় সমস্ত শক্তিই বলে থাকে, গেরুয়াবাহিনী দেশে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি করছে। আপনার মত?
প্রকাশ: দেখুন, আমাদের দেশের সব রাজনৈতিক দলই কমবেশি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে। এটা নতুন নয়। কিন্তু এই সরকার সাম্প্রদায়িক রাজনীতিটাকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে দিতে চাইছে। এবং একটা অংশ ঠাণ্ডা ঘরে বসে ঘৃণার রাজনীতি আরও কীভাবে সমাজের গভীরে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তার পরিকল্পনা করছে।

ঘড়িতে তখন এগারোটা পঞ্চাশ। হাসতে হাসতে থামিয়ে দিয়ে বললেন এখন আর প্রশ্ন নয়। এ বার একটা সিগারেট ধরাতে হবে। জিনসের পকেট থেকে একটা ইনসিগনিয়া বের করে ঠোঁটে রেখেই বলতে শুরু করলেন আবার...
জানেন, গত বছর আমি ডিওয়াইএফআই-এর কর্নাটক রাজ্য সম্মেলনে গেছিলাম। আমি একটা মঞ্চ চেয়েছিলাম আমার কথা বলার জন্য। ওঁরা সেটা দিয়েছিল। তারপর ওরা বলল আমি সিপিএম। জেএনইউ-এর ছাত্র নেতা কানহাইয়া কুমারের বক্তৃতার প্রশংসা করে টুইট করেছিলাম। তখন বলল আমি নাকি সিপিআই। রাফায়েল নিয়ে প্রশ্ন তুললাম। দেগে দিল 'কংগ্রেস ম্যান' বলে। সে ওরা আমায় যাই বলুক, প্রশ্ন আমি করবই। বেকারদের চাকরি, শিক্ষার অধিকার, মানুষের সমানাধিকার নিয়ে প্রশ্ন আমি করবই। আমার বিজেপি-কে ভাল না-ই লাগতে পারে। তার মানে এই নয় যে, আমি কংগ্রেস, সিপিএম বা সিপিআই। আমি কংগ্রেসকে নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারি।”
সিগারেটটা নেভাতে নেভাতে বলে দিলেন, “উই দ্য পিপল। উই আর দ্য বস।”