শেষ আপডেট: 25th May 2018 06:00
দ্য ওয়াল ব্যুরো: —নাম কী? জোরে বল।
—জামাল মোমিন।
—ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নাম কী?
—মমতা।
—ওয়েস্ট বেঙ্গলের মুখ্যমন্ত্রীর নাম বল।
—ওয়েস্ট বেঙ্গলে? কালিয়াচকে নামব।
—ধুর বাঁ*, তোকে বলছি ওয়েস্ট বেঙ্গলের সিএম-এর নাম কী?
—বললাম তো, মমতা।
—তা হলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নাম কী?
—(থতমত খাওয়া হাসি)
—বোকা** ভারতে থাকো, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নাম জানো না?
—বলতে পারব না।
—ভারতের রাষ্ট্রপতির নাম বল। ভারতের জাতীয় সঙ্গীত কী, বল।
—ওটা আমার জানা নেই।
—সপাটে ছুটে যায় থাপ্পড়। সঙ্গে অশ্লীল গালিগালাজ।
—থাকিস কোথায়?
—বাঙ্গালে থাকি গো।
—গালিগালাজ বাড়ে। আঙুল উঁচিয়ে প্রশ্ন আসে, জাতীয় সঙ্গীত জানিস না কেন।
—জনগণমন বলতে পারিস?
—গড়গড় করে খানিকটা আউড়ে দেয় যুবক। বলে, জনগণ জানি। ওটা যে জাতীয় আমি বুঝতে পারব?
—ফের গালিগালাজ।
—আমি তো লেখাপড়া শিখি নাই গো।
কথা চলতে থাকে। কথা না বলে হুমকি বা অপমান বলাই ভাল। অশ্লীল গালিগালাজ আর চড়-থাপ্পড়ের সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হয়, ভারতে বাস করে প্রধানমন্ত্রীর নাম না জানাটা অথবা জাতীয় সঙ্গীত কী সেটা না বলতে পারার অন্যতম কারণ, মানুষটি মুসলমান ধর্ম পালন করেন। সেই সঙ্গে এ-ও ফরমান দেওয়া হয়, এই তথ্যগুলি না জানার অপরাধে তাঁকে প্রতিবেশী দেশে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। ক্রমে সিঁটিয়ে যান জামাল মোমিন নামের ওই যুবক। অপমানে নীল হয়ে যান। একটি ট্রেনযাত্রার দৃশ্য এমনটাই।
শুধু তা-ই নয়। এই গোটা পর্বটার ভিডিও রেকর্ডিং হল মোবাইলে। যাঁরা করলেন, তাঁরাই ছিলেন যুবকের উল্টো দিকে। এখানেই থামলেন না তাঁরা। ভিডিওটি ছড়িয়ে দিলেন সোশ্যাল মিডিয়াতেও। বুধবার রাতে এই ভিডিও আপলোড হয় ফেসবুকে। দৃশ্যতই দরিদ্র এবং ন্যূনতম পড়াশোনা না জানার কথা বারবার করে বলতে থাকা যুবকটিকে এ ভাবে হেনস্থা করার ঘটনা ঘিরে প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে নাগরিক সমাজ।
নিন্দার ঝড় ওঠে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এক দিনের মধ্যে কয়েক লক্ষ মানুষ দেখেন ভিডিওটি, কয়েক হাজার শেয়ার হয় ভিডিওটি। নেটিজেনদের একটা বড় অংশেরই বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রীর নাম বা জাতীয় সঙ্গীত না জানার ‘অপরাধে’ এই ভাবে প্রকাশ্যে কাউকে মারধর করা যায় না। যদিও তার মধ্যেই এ ধরনের বক্তব্যও লুকিয়ে রয়েছে, “দেশবাসী হয়ে দেশের জাতীয় সঙ্গীত না জানা কোনও কাজের কথা নয়”। কিন্তু এ সব ছাপিয়ে অনেক বেশি ঝড় তুলেছে ওই ভিডিও নির্মাণকারী ব্যক্তিদের প্রতি ঘৃণা, সমালোচনা।
সূত্রের খবর, ওই যুবকের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা গিয়েছে। তাঁর স্ত্রী জানিয়েছেন ঘটনার সত্যতা। তাঁকে দিয়ে থানায় এফআইআর দায়ের করিয়েছে ‘বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ’। ওই যুবক কর্মসূত্রে অন্য রাজ্যে থাকেন। তিনি ফিরে যাওয়ায় সরাসরি যোগাযোগ করা যায়নি তাঁর সঙ্গে। এমনকী ঘটনাটি ঠিক কবে, কোথায়, কোন ট্রেনে ঘটেছে, তা-ও নিশ্চিত করা যায়নি। সম্ভবত কাজের জায়গা থেকে কালিয়াচকে ফেরার সময়েই ট্রেনে এই হেনস্থার শিকার হন তিনি। এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি, ভিডিওর অন্য প্রান্তে থাকা মানুষগুলির পরিচয়।
আরও পড়ুন: উন্মত্ত জনতার হাত থেকে মুসলিম কিশোরকে বাঁচালেন একা পুলিশকর্মী
বস্তুত, এই ঘটনা এবং ঘটনাকে ঘিরে বেড়ে ওঠা ঝড় বেশ কয়েকটি প্রশ্ন তুলে দিল মানুষের সামনে। তুলে দিল চোরা আতঙ্কও। তা হলে কি এভাবেই সমাজের বিভিন্ন স্তরে নিক্তি দিয়ে‘দেশপ্রেম’ মাপার দায়িত্ব নিচ্ছেন এক শ্রেণির মানুষ? এবং সেই দায়িত্ব কি রীতিমতো উদযাপন করছেন ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। এবং সেই সঙ্গে প্রশ্ন, এই চাপিয়ে দেওয়া দেশপ্রেমের থাপ্পড় কি পিছিয়ে পড়া, অশিক্ষিত সম্প্রদায়ের মানুষের গালেই সহজে এসে পড়ছে?
সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় যেমন জানাচ্ছেন, আজকাল এমন ঘটনা নতুন নয়। এই ক্ষেত্রে হয়তো সোশ্যাল নেটওয়ার্কের দৌলতে এত তোলপাড় হয়েছে, কিন্তু নানা রকম বিষয়কে অজুহাত করে তুলনামূলক ভাবে কমজোরি শ্রেণির প্রতিনিধিদের প্রতি নানা রকমের উগ্র আচরণ চলতেই থাকে। এ ক্ষেত্রে, ওই তথাতথিত শিক্ষিত এবং দেশপ্রেমী মানুষগুলি মনুষ্যত্বের পরিচয় দেননি। তাঁর কথায়, “এমনটা হতেই পারে, ওই দরিদ্র যুবক তাঁর জীবনযুদ্ধের তাড়নায় এই সমস্ত তথ্য জেনে উঠতে পারেননি। তা তো অন্যায় নয়। বরং এটা আমার দেশের শিক্ষাব্যবস্থার গলদ। আর ওই মুহূর্তে দেশপ্রেমে উদ্বেল হয়ে যাঁরা গায়ে হাত পর্যন্ত তুললেন, তাঁদের কাছে যদি সত্যিই মনে হতো, প্রধানমন্ত্রীর নাম না জানাটা বা জাতীয় সঙ্গীত চিহ্নিত না করতে পারাটা লজ্জার, তবে তাঁরা তো তা শিখিয়ে দিতে পারতেন। দেশকে ভালবেসে, দেশেরই খেটে খাওয়া মানুষকে এমন অপমান তো করা যায় না!”
দেখে নিন, ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিওর সম্পাদিত অংশ।
https://www.youtube.com/watch?v=uJ_cbHxOzpA