শেষ আপডেট: 26th March 2023 03:31
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ববি হাকিম (Firhad Hakim) রবীন্দ্রনাথ আওড়ে বলেছিলেন, ‘কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে! কর্পোরেশন নিয়ে বলুন, বলছি। অন্য কিছু না। অনলি কর্পোরেশন।’ কবে বলেছিলেন? ১৮ মার্চ, শনিবার। কেন বলেছিলেন? কারণ, তার ঠিক আগের দিন কালীঘাটে দলের বৈঠকে ববিকে সংবাদমাধ্যমে মুখ খোলা নিয়ে ভর্ৎসনা করেছিলেন দিদি। তৃণমূল (TMC) সূত্রে জানা গিয়েছিল, ববিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট বলেছিলেন, কর্পোরেশন বাদ দিয়ে অন্য কোনও বিষয়ে তিনি যেন কথা না বলেন। তার জন্য দলের মুখপাত্ররা রয়েছেন। তাঁরা বলবেন।
কিন্তু ববি যেন এক সপ্তাহে ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন। আর একটা শনিবার কার্যত তৃণমূলের বিবেক হয়ে আবির্ভূত হলেন কলকাতার মহানাগরিক। তাঁর দু’টি মন্তব্য নিয়ে কার্যত আলোড়ন পড়ে গিয়েছে। একটি মন্তব্য নিয়ে তৃণমূলের মধ্যেও কৌতূহল তৈরি হয়েছে, কাকে চ্যালেঞ্জ করতে চাইলেন তিনি?
এখন দেখে নেওয়া যাক কোন মন্তব্যে কী বলেছেন ববি—
২০১১ সালে তখন সদ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেছেন। খাদ্যমন্ত্রী হয়েছেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক (Jyotipriyo Mallick) ওরফে বালু। সেবছরই জ্যোতিপ্রিয় একটি সভায় বলেছিলেন, সিপিএম বিষধর সাপের মতো। লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারা উচিত। সেইসঙ্গে বালু এও বলেছিলেন, সিপিএমের সঙ্গে কারও বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ানো উচিত নয়, একসঙ্গে বসে চা খাওয়া উচিত নয়। এমনকি সিপিএমের কেউ যদি কোনও বিয়েবাড়িতেও নেমন্তন্ন খেতে যায়, সেই অনুষ্ঠানও বয়কট করা উচিত। একযুগ পর সেই জ্যোতিপ্রিয় পুরনো স্লোগানকে এখন প্রাসঙ্গিক বলে দাবি করেছেন শনিবার।
হাবড়ায় বনমন্ত্রী বলেন, ‘সিপিএম বীভৎস, ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক দল। আমি ২০১১ সালে যে কথা বলেছিলাম এখনও সেটাই প্রযোজ্য। আমি অন্তত আমার ক্ষেত্রে এটা করি। সিপিএমের সঙ্গে চা খাই না, গল্প করি না।’
এখন বালুর এই কথা কি কলকাতা পুরসভা নিয়ে? তা নয়। কিন্তু ববি হাকিম শনিবার কণ্ঠের রুদ্ধদ্বার ভেঙে দিতে চেয়েছেন। বলেছেন, ‘সিপিএম বাড়ির যদি কেউ অসুস্থ হয়, তাহলে কাউন্সিলর হিসাবে, মন্ত্রী হিসাবে আমার দায়িত্ব তাঁকে দৌড়ে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা। সামাজিক বয়কট-টয়কট এসব সিপিএম করত। আমরা এগুলো বিশ্বাস করি না। আমরা বিশ্বাস করি বিবেকানন্দের কথায়, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ যদিও বাংলা সাহিত্যের ছাত্ররা বলছেন, 'শুন মানুষ ভাই/ সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই', এই পংক্তিটি কবি চণ্ডীদাসের রচনা। সেটাই ফিরহাদ হাকিম বিবেকানন্দর বাণী বলে উল্লেখ করেছেন।
এ ব্যাপারে রাজনৈতিক মহলের অনেকে দু’টি দিক দেখতে পাচ্ছেন। এক, ববি সামাজিক সুস্থ পরিমণ্ডলের বার্তা দিতে চেয়েছেন। বোঝাতে চেয়েছেন, রাজনীতি রাজনীতির জায়গায়। কিন্তু বন্ধুত্ব, বিপদ-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যে রাজনীতি না টানাটাই দর্শন হওয়া উচিত। সেইসঙ্গে রাজনৈতিক মহলের কেউ কেউ এও বলছেন, ববি বিবেকানন্দের বাণী উচ্চারণ করে বালুকে বার্তা দিয়েছেন ঠিকই, একইসঙ্গে তিনি যেন কর্পোরেশনের বাইরে কথা না বলার ‘লক্ষ্মণরেখা’ ডিঙিয়ে যেতে চেয়েছেন।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্যটি করেছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহর (Udayan Guha) বক্তব্যের প্রেক্ষিতে। উদয়ন দীর্ঘ সময় বাম রাজনীতি করেছেন। তিনি ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। তাঁর বাবা প্রয়াত কমল গুহ ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের অবিসংবাদী নেতা। কমলবাবু দীর্ঘদিন বামফ্রন্ট সরকারের খাদ্য মন্ত্রীও ছিলেন।
তৃণমূল যখন বাম জমানার নিয়োগ দুর্নীতিকে সামনে এনে সিপিএমের থোঁতা মুখ ভোঁতা করতে দৌত্য শুরু করে দিয়েছে তখন উদয়ন শনিবার বলেছেন, ‘আমার বাবার সামনে বসে তালিকা তৈরি হত। সেই তালিকাকে এনডোর্স করে দিত বাবা।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেই তালিকায় যোগ্যদের বঞ্চিত করে অযোগ্যদের সুযোগ দেওয়া হত।’
সংবাদমাধ্যম এ নিয়েও ববি হাকিমকে প্রশ্ন করছিল। কর্পোরেশনে বসে মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী বলেন, ‘উদয়ন কী পাগলের মতো বকেছে আমার জানা নেই। চিরকুটে কখনও লোক ঢোকানো যায় না, কমপক্ষে একটা অ্যাপ্লিকেশন লাগে। আগে যখন সার্ভিস কমিশন ছিল না বা নিয়োগের নিয়ম ছিল না তখন স্কুলগুলোর পরিচালন কমিটি শিক্ষক নিয়োগ করত। পুরসভাতেও স্থানীয়দের নিয়োগ করা হত।’
রাজনৈতিক মহলের অনেকেই বলছেন, উদয়ন সম্পর্কে ববি ‘পাগল’ বললেন সেটা বড় ব্যাপার নয়। তার চেয়েও অনেক ব্যাপার হল, চিরকুট মন্তব্য। তৃণমূল সূত্রেই জানা গিয়েছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কালীঘাটের বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে বলেছেন, ১৯৯০-২০১১ পর্যন্ত বাম জমানায় শিক্ষা দফতরে যে সব চিরকুটে চাকরি হয়েছিল তার তালিকা প্রকাশ করতে। ইতিমধ্যেই সুজন চক্রবর্তীর স্ত্রী'র কলেজে চাকরির জয়েনিং লেটার নিয়ে জলঘোলা হয়েছে। সুজন-জায়া সংবাদমাধ্যমে এসে বলেছেন, ‘ক্ষমতা থাকলে প্রমাণ করুন পরীক্ষা ছাড়া চাকরি পেয়েছি। কেন রেজাল্ট শিট প্রকাশ করলেন না?’
কিন্তু কৌতূহল হল, ববি এদিন যখন মন্তব্য করেছেন চিরকুটে কখনও চাকরি হয় না তখন তিনি কি অবচেতনভাবেই দলকে চ্যালেঞ্জ করে দিলেন? সেই কৌতূহলের নিরসন আগামী দিনে হবে কিনা স্পষ্ট নয়, তবে জল্পনা কি আর থেমে থাকে?