শেষ আপডেট: 22nd September 2023 14:25
দ্য ওয়াল ব্যুরো, পূর্ব বর্ধমান: শিক্ষকের অভাবে বন্ধ হতে বসেছিল জামালপুর ব্লকের (East Burdwan) বসন্তপুর জুনিয়ার হাইস্কুল (school)। হাল ধরলেন এলাকার পাঁচ শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী। তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় এক অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। বেতনের প্রত্যাশা না করেই শুধুমাত্র এলাকার পড়ুয়াদের মুখ চেয়ে তারা এই সরকারি স্কুলে পড়িয়ে যাচ্ছেন। এলাকাবাসী তাঁদের কুর্নিশ জানালেও এইভাবে কতদিন স্কুলে পঠনপাঠন জারি রাখা সম্ভব হবে তা নিয়ে অবশ্য দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তাঁরা।
নিয়োগ দুর্নীতিতে জেরবার রাজ্যের স্কুল শিক্ষা দফতর। শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া লাটে উঠতেই শিক্ষকের আকাল দেখা দিয়েছে রাজ্যের অনেক স্কুলেই। বসন্তপুর জুনিয়ার হাইস্কুলও এর ব্যতিক্রম নয়। জামালপুরের পাড়াতল ১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম বসন্তপুর। এক সময়ে এই গ্রামের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা লাভের ভরসা বলতে ছিল শুধুমাত্র একটি প্রাথমিক স্কুল। লেখাপড়া শেখার জন্য বসন্তপুর ও সংলগ্ন বেত্রাগড়, সজিপুর প্রভৃতি গ্রামের ছেলেমেয়েদের পাঁচ কিলোমিটার দূরে জামালপুর বা সেলিমাবাদ হাইস্কুলে যেতে হত। এই দূরত্ব স্কুল বিমুখ করে তুলছিল এলাকার দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া পরিবারের ছেলেমেয়েদের। গ্রামের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার স্বার্থে একটি জুনিয়র হাইস্কুল তৈরির জন্য অগ্রণী ভূমিকা নেন স্থানীয় অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঘোষ।
কিন্তু অনুমোদনের নথিতে ত্রুটি থাকায় ‘প্রস্তাব’ ফেরত চলে যায়। এরপর থেকে স্কুল ঘর তৈরি নিয়ে টালবাহানা চলতেই থাকে। এমনকী স্কুলের জন্য জমি পাওয়া নিয়েও চূড়ান্ত জটিলতা তৈরি হয়। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। শেষমেষ স্কুল তৈরির জন্য সরকারের তরফে বসন্তপুর গ্রামে দুই বিঘার মত জমি বরাদ্দ করা হয়। তারপর পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি ওই জমির তথ্য উল্লেখ করে সেখানে স্কুল তৈরির অনুমোদন দেয়। আগের পাওয়া ৪ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকায় ওই বছরেরই শেষের দিকে স্কুল ঘর তৈরির কাজ শুরু হয়। ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর জন্য চারজন গেস্ট টিচারও মেলে।এখন স্কুলের ১৩৯ জন পড়ুয়ার মিডডে মিল রান্নার ঘর ছাড়াও টিচার্স রুম সহ পাঁচটি ঘর রয়েছে। এছাড়াও অপর একটি ঘরের নির্মাণ কাজ চলছে।
আরও পড়ুন: স্পেনে বসে অরূপের পুজোর গান লিখলেন মমতা, সুরও দিলেন সুরুচি সঙ্ঘের থিম সংয়ের
কিন্তু এত কিছুর পরেও স্বস্তিতে নেই বসন্তপুর জুনিয়র হাইস্কুলের পড়ুয়া ও তাদের অভিভাবকরা। এখন স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ভুগছেন তাঁরা। কারণটাও চমকে দেওয়ার মতই! দ্বিজেনবাবু বলেন, “আমাদের স্কুলের জন্য ২০১৮ সালে তিনজন স্থায়ী শিক্ষক অনুমোদন হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এখনও পর্যন্ত স্কুলে একজনও স্থায়ী শিক্ষক নেই । অতিথি শিক্ষকদের অধিকাংশই ইতিমধ্যে অবসর নিয়েছেন। এখন গোটা স্কুলের দায়িত্বে রয়েছেন মাত্র একজন অতিথি শিক্ষক। তার একার পক্ষে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্র ছাত্রীদের পঠন পাঠনের দায়ভার সামলানো সম্ভব নয়।
শিক্ষকের আকালেই স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। স্কুলে তালা পড়া আটকাতে বেতনের প্রত্যাশা না করেই তিনি এবং আরও পাঁচ শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতী পড়ুয়াদের পাঠদানের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সুমন মাঝি ও স্বাগতা ঘোষ বাংলায় এমএ। শিল্পা সাহা ভূগোল ও সহেলি মণ্ডল ইতিহাসে এমএ পাশ করেছেন। আর বিশ্বজিৎ মিত্র বিএসসি পাশ। এঁদের সবার বিএড কোর্সও সম্পূর্ণ করা রয়েছে। দ্বিজেনবাবু বলেন, ‘‘নিঃস্বার্থে এই শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা পাশে দাঁড়িয়েছে বলেই এখনও স্কুলটি টিকিয়ে রাখা গেছে।’’ তবে স্থায়ী শিক্ষক ছাড়া এইভাবে আর কতদিন স্কুলটি চালানো সম্ভব হবে তা নিয়েও দ্বিজেনবাবুও সংশয় প্রকাশ করেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা অরিজিত মণ্ডল ও সূর্যকান্ত ঘোষরা আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘শুধু স্থায়ী শিক্ষকের আকালে আমাদের গ্রামের স্কুলটি ভুগছে এমনটা নয়, স্কুলের জমি নিয়েও জটিলতা জিইয়ে রয়েছে।’’ দ্বিজেনবাবু বলেন, ‘‘২০১৪ সালে স্কুল প্রতিষ্ঠার পর আজও সরকার থেকে পাওয়া জমি স্কুলের নামে রেকর্ড হয়নি। কোভিড পরিস্থিতির আগে স্কুলের জমি সংক্রান্ত খোঁজখবর শেষ করে রেকমেন্ডেশনের জন্য ‘কমিশনার অফ ল্যান্ড রিফর্ম ডিপার্টমেন্ট তথ্য-সহ ফাইল নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে পাঠায়। সেই রেকমেন্ডেশন যাচাইয়ের জন্য নবান্ন থেকে ওই ফাইল বিকাশভবনে এডুকেশন ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট এই ব্যাপারে কোনও হেলদোল দেখাচ্ছে না।’’ ফাইল হারিয়ে গেছে বলে মৌখিক ভাবে জানিয়ে এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের কর্তারা শুধু পাশ কাটিয়েই যাচ্ছেন বলে দ্বিজেনবাবু মন্তব্য করেছেন।
এদিকে বসন্তপুর গ্রামের স্কুলের এমন দুরাবস্থার কথা জেনে জামালপুরের প্রাক্তন বাম বিধায়ক সমর হাজরা কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। তিনি বলেন,“তৃণমূল সরকারের রাজত্বে বাংলার স্কুলগুলির ভবিতব্য এটাই হতে যাচ্ছে।’’ যদিও জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাঝি বলেন, “স্কুল বাঁচাতে পাঁচ শিক্ষিত যুবক যুবতী যে ভাবে এগিয়ে এসেছেন, তাকে কুর্নিশ জানাই। স্কুলে স্থায়ী পদে একজনও শিক্ষক না থাকা এবং স্কুলের জমি নিয়ে যে সমস্যা রয়েছে সেই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নথিপত্র পেলে আমি সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করব।’’