শেষ আপডেট: 7th June 2023 08:00
দ্য ওয়াল ব্যুরো, পূর্ব বর্ধমান: কুলীনগ্রামের জগন্নাথের পুরনো মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে গেছে সেই কবে। মন্দিরের প্রবেশদ্বারটি অবশ্য প্রাচীন ঐতিহ্যকে জানান দিতে এখনও টিকে আছে মাথায় বটগাছের বোঝা নিয়ে। পুরোনো মন্দিরের বিগ্রহগুলিকে স্থাপন করা হয় বহু পরে নির্মিত মন্দির দালানে। পরে সংস্কারও করা হয় সেই দালানের। এই মন্দিরেই স্থাপন করা হয়েছে পুরোনো মন্দিরে থাকা প্রাচীন গড়ুর এবং বিষ্ণু মূর্তিকে।
কথিত আছে, লক্ষ্মীনাথ বসু প্রতিষ্ঠা করেন জগন্নাথ মূর্তির। স্থানীয়দের মতে জগন্নাথ বিগ্রহ পাঁচশো বছরেরও বেশি পুরোনো হলেও রথযাত্রার প্রচলন হয় অনেক পরে, দু’ থেকে আড়াইশো বছর আগে। কুলীনগ্রামের জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম নিমকাঠের তৈরি। স্নানযাত্রার পর নতুন করে মূর্তির নবরাগ অর্থাৎ নতুন রং করা হয়। রথযাত্রার ঠিক দু'দিন আগের অমাবস্যায় নতুন বস্ত্র পরিয়ে তোলা হয় সিংহাসনে। রথযাত্রার দিন দুপুরে বিগ্রহের জন্য পুরনো রীতি মেনে অন্নভোগ দেওয়া হয়। পঞ্চব্যঞ্জন সহ জগন্নাথদেবকে দেওয়া হয় খিচুড়ি ভোগ, বলরামের জন্য সাদা অন্নভোগ, সুভদ্রার জন্য পায়েস। বিকেল হলে বিগ্রহ মন্দিরের সিংহাসন থেকে এনে রথে তোলা হয়। তার আগে সাতবার পরিক্রমা করা হয় রথ।
ভোগ দেওয়ার পর সেবাইত পরিবারের প্রবীণ সদস্য রথের ওপর বসেন। তিনি বিগ্রহের কলেবর স্পর্শ করে থাকেন। তারপরেই টান পড়ে রথের রশিতে। রথ চলে যায় গোপেশ্বর শিবমন্দির সংলগ্ন ষষ্ঠী বটতলায়। এরপর বিগ্রহ আনা হয় জগন্নাথ মন্দিরের উল্টোদিকে পুকুরের অন্যপাড়ে রঘুনাথ বাড়ি বা মাসির বাড়িতে। রঘুনাথজিউ মন্দিরে অধিষ্ঠিত আছেন রাম-সীতা-লক্ষ্মণ-হনুমান। এছাড়াও আছে কালো পাথরের শিবলিঙ্গ। এখানেই উল্টোরথ পর্যন্ত অবস্থান করেন জগন্নাথ-সুভদ্রা ও বলরাম।
তবে বর্তমানে বসু পরিবারের কোনো সদস্যই কুলীনগ্রামে থাকেন না। রথের মেলার দায়িত্ব স্থানীয় গাঙ্গুলী পরিবারের । এখন যে রথটি টানা হয় সেটি তিন নম্বর রথ। পঞ্চাশ বছর আগে তৈরি হয়েছে তিরিশ ফুট উঁচু এই রথটি। সারা বছর রোদ-জলের হাত থেকে বাঁচাতে ছাদ দেওয়া ঘর তৈরি করা হয়েছে। চার-পাঁচ বছর অন্তর অন্তর রথের রশি পাল্টানো হয়। নারকেলের তৈরি রশি চালু থাকলেও বছর তিনেক হল নাইলনের রশি দিয়েই রথ টানা হয়। পুরোনো রথের রশি কেটে বিক্রির রীতি চালু আছে এখনও। লোকবিশ্বাস এই রশি পবিত্র এবং বাড়িতে রাখলে সংসারের মঙ্গল হয়।
‘কায়স্থ কুলেতে জন্ম কুলীনগ্রামে বাস’ -ভনিতায় ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’-এর কবি মালাধর বসু তাঁর নিবাসের উল্লেখ করেছেন। কুলীনগ্রাম নামের সার্থকতা বোধ হয় এই গ্রামের সুসন্তানদের জন্যই। মালাধর বসু জন্মগ্রহণ করেছিলেন পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগেই। শ্রীমদ্ভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অবলম্বনে তাঁর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের’ রচনাকাল ১৪৭৩-৮০ খ্রিস্টাব্দ। অর্থাৎ শ্রীচৈতন্যের (১৪৮৬-১৫৩৩) আবির্ভাবের আগেই রচিত হয়েছিল এই কাব্য। মালাধর বসুর পৌত্র রামানন্দ বসু ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তরঙ্গ পার্ষদ। ইতিহাস বলে বসু পরিবারের আমন্ত্রণেই শ্রীচৈতন্যদেব কুলীনগ্রামে আসেন এবং তিন দিন অবস্থান করেন। চৈতন্যমঙ্গলেও রয়েছে সেই তথ্য। রামানন্দ বসুর শ্রীপাট রূপে পরিচিত কুলিনগ্রাম এক সময়ে বৈষ্ণবতীর্থস্থান হিসেবে দেশজোড়া খ্যাতি লাভ করেছিল।
কথিত, বসু পরিবারের কৃষ্ণভক্তি দেখে শ্রীচৈতন্যদেব প্রতি বছর পুরীতে স্নানযাত্রায় কুলীনগ্রাম থেকে পট্টডোরি পাঠানোর দায়িত্ব দেন। পট্টডোরি হল তুলোর ওপর নানা রঙের রেশম সুতো দিয়ে পাকানো কাছি বা বন্ধনী। এই কাছি দিয়েই জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাকে রথের সঙ্গে বাঁধা হত এবং গলাতে মালার মতো পরানো হত। পরবর্তীকালে এই পট্টডোরি সরবরাহে অবশ্য ছেদ পড়ে।
তবে এই কুলীন গ্রামের ঐতিহ্যের রথ বের হয় এখনও। এ বার অবশ্য করোনা পরিস্থিতিতে প্রথম ছেদ পড়ল তাতে। তবে প্রথা মেনে পুজো আর জগন্নাথ সুভদ্রা বলরামকে ভোগ নিবেদন করা হয়েছে।
পুরীর জগন্নাথদেবের ‘রোসাঘর’, বিশ্বের সর্ববৃহৎ রন্ধনশালা, আয়োজন দেখে হতবাক হতে হয়