শেষ আপডেট: 15th November 2021 10:37
ফার্স্টক্লাস গ্র্যাজুয়েট পুরুলিয়ার শবর-কন্যা শকুন্তলা, ফের শিক্ষার মাইলফলক জনজাতির ইতিহাসে
দ্য ওয়াল ব্যুরো: তারা 'পিছিয়ে থাকা' জনজাতি। তারা দরিদ্র, অশিক্ষিত, অপরাধপ্রবণ, মাদকাসক্ত! তাদের নিয়ে এ সমস্ত গুজব আজও ঘুরে বেড়ায় দেশজুড়ে। এই ২০২১ সালেও তাদের মানবাধিকার তলানিতে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজের অধিকারে প্রান্তিক তারা। তবে তার মধ্যেই 'আলো ক্রমে আসিতেছে'। পিছিয়ে থাকার শিকড় ছিঁড়ে, সমাজবিরোধীর তকমা ঘুচিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথযাত্রী অনেকেই। শকুন্তলা শবর (Sakuntala Sabar) তাঁদেরই একজন। গত বছর শবর সম্প্রদায়ের মহিলাদের মধ্যে প্রথম স্নাতক হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন রমনিতা শবর। এবার তাঁরই পথে দ্বিতীয় নামটি লেখালেন শকুন্তলা। ঝাড়খণ্ডের কলহান বিশ্ববিদ্যালয়ের পটমদা কলেজে হিন্দিতে অনার্স নিয়ে পাশ করেছেন শকুন্তলা। শুধু পাশ করা নয়, পেয়েছেন ফার্স্ট ক্লাস, ৬২ শতাংশেরও বেশি নম্বর! গত বছর রমনিতার সঙ্গেই পাশ করার কথা ছিল তাঁর। শারীরিক অসুস্থতায় এক বছরের জন্য পিছিয়ে যায় ফাইনাল পরীক্ষা। গত বৈশাখে বিয়ে করে জামশেদপুরে থাকতে শুরু করেন শকুন্তলা। তবে বিয়ের পরেও বন্ধ হয়নি লেখাপড়া। বরাবাজার থানার ফুলঝোর গ্রামের বাসিন্দা শকুন্তলারা তিন বোন, দুই ভাই। বাবা মঙ্গল শবর অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। মা ঊর্মিলা শবর কাঠ কুড়িয়ে লোকের বাড়িতে বিক্রি করেন। এই ভাবেই চলে তাঁদের অভাবের সংসার। কিন্তু এত অনটনেও মঙ্গল-ঊর্মিলা স্বপ্ন দেখেছেন, পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে ছেলেমেয়েরা। সব বাধা পেরিয়ে মানুষের মতো মানুষ হয়ে দাঁড়াবে সামনের সারিতে। পুরুলিয়ায় শবরদের মধ্যে প্রথম স্নাতক রমনিতা সে স্বপ্ন সত্যির পথে পরিবারে প্রথম আলোটা জ্বাললেন বড় মেয়ে শকুন্তলা। তবে শকুন্তলা একা নন। শবর সম্প্রদায়ের কোনও পরিবার থেকে তিন-তিন জন মাধ্যমিক পাশ ছেলে-মেয়ের খোঁজ পাওয়া খুব মুশকিল। কিন্তু মঙ্গল-ঊর্মিলা তাঁর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় এতটাই গুরুত্ব দিয়েছেন। শকুন্তলার পরের বোন, মেজো মেয়ে বাসুমতী শবর ইংরেজি অনার্সে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। বড় ছেলে ইলেভেনে পড়ছে। গত বছর ছোট ছেলে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল। এই বছর ছোট মেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবে। তাঁদের ছোট ছেলে এবং ছোট মেয়ে এখন পুঞ্চা নবদিশা মডেল স্কুল থেকে পড়াশোনা করছে। এই স্কুলটি 'পুলিশ বাবা' অরূপ মুখোপাধ্যায়ের স্কুল বলেই পরিচিত। এই এলাকায় শবর জনজাতির উন্নতিসাধনে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে চলেছেন অরূপবাবু। পেশায় কলকাতা পুলিশের কর্মচারী এই মানুষটির আবাসিক স্কুল রয়েছে পুঞ্চায়, একশোর ওপর শবর শিশু সেখানে শিক্ষার আলো দেখে। অরূপবাবুই আরও শতাধিক শবর ছেলেমেয়ের সঙ্গেই শকুন্তলা ও তাঁর ভাইবোনদের পড়াশোনার সমস্ত খরচ চালান। কোনও দিন কোনও অসুবিধা হতে দেননি। তাঁরই চেষ্টায় তিন বছর আগে 'টেলিগ্রাফ স্কলারশিপ' পেতে শুরু করেন রমনিতা, শকুন্তলা, বাসুমতীরা। এই শবর পড়ুয়াদের জন্য আরও অনেকেই তাঁকে আর্থিক ভাবে সাহায্য করেন বলেও জানালেন অরূপ। এ দেশে তখন রাজ করছিল ব্রিটিশরা। পিছিয়ে থাকা দারিদ্রের মুখ শবরদের গায়ে সমাজবিরোধীর তকমা সেঁটে দেওয়া হয়েছিল তখন থেকেই। স্বাধীনতার পরেও অবস্থা পাল্টায়নি। পাল্টায়নি স্বাধীনতার এত বছর পরেও। একরকম অভিমানেই সভ্য সমাজ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখার আদত তৈরি করে ফেলেছিলেন তাঁরা। এখনও শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই অনেক অনেক পিছিয়ে শবর জনজাতির মানুষগুলো। বিচ্ছিন্ন ভাবে শবর জনজাতির ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা শুরু করলেও মাঝপথেই ছেড়ে দিতেন অনেকে। ইতিপূর্বে দু-একজন কলেজে ভর্তি হলেও শেষপর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে যাননি তাঁদের বেশিরভাগ। ব্যতিক্রম ফুলঝোর গ্রামের রমনিতা, শকুন্তলারা। পড়ুন দ্য ওয়ালের সাহিত্য পত্রিকা 'সুখপাঠ'