শেষ আপডেট: 1st June 2023 10:03
আলিপুর চিড়িয়াখানায় ১০০ বছর আগে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন এই বাঙালি ডাক্তার, কৃত্রিম প্রজননের পথিকৃৎ
দ্য ওয়াল ব্যুরো: এ' যেন আরেক জগদীশচন্দ্র বোস বা ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গল্প (Ram Brahma Sanyal)। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনসিনাটি চিড়িয়াখানায় কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বন্দিদশায় জন্ম নিয়েছিল একটি সুমাত্রার গণ্ডারশাবক। বলা হচ্ছিল, বিশ্বের মধ্যে প্রথম! অথচ আমরা প্রায় কেউ জানিই না, ১১২ বছর আগে এই একই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন এক বাঙালি বিজ্ঞানী (Ram Brahma Sanyal)! তাও আবার খাস কলকাতায়, আলিপুর চিড়িয়াখানায়!
তাঁর নাম রামব্রহ্ম সান্যাল (Ram Brahma Sanyal)। আলিপুর চিড়িয়াখানার (Alipore Zoo) প্রথম ভারতীয় অধিকর্তা। বয়সে রবীন্দ্রনাথের চাইতে বছরতিনেক বড় রামব্রহ্মের জন্ম মুর্শিদাবাদের লালগোলার কাছে, মহুলা গ্রামে। প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে রামব্রহ্ম ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হ'ন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। কিন্তু বিধি বাম। ছাত্র হিসেবে রীতিমত 'ব্রিলিয়ান্ট' বলে পরিচিত রামব্রহ্মের চোখে সমস্যা দেখা দেয়। দৃষ্টিশক্তি কমে গেলে ডাক্তারি করবেন কী করে? অতএব তাঁর এক অধ্যাপক, জর্জ কিং তাঁকে ডাক্তারি থেকে সরিয়ে চাকরি জুটিয়ে দেন আলিপুর চিড়িয়াখানায়।
তখনও অবশ্য সেই চিড়িয়াখানা পুরোপুরি তৈরি হয়নি। একটু একটু করে খাঁচাগুলোর কাজ চলছে। রামব্রহ্ম ঢুকলেন কেরানি হয়ে। অধ্যাপক জর্জ কিং যদিও তাঁর ছাত্রকে চিনতেন। ইনি নিজেও ছিলেন এক কীর্তিমান পুরুষ। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ডাকসাইটে সার্জন এই কিং সাহেবই পরে শিবপুরের বটানিক্যাল গার্ডেনের অধিকর্তার দায়িত্বে আসেন। তখন ম্যালেরিয়ার প্রকোপে কাঁপত সারা পুব ভারত। কিং সিঙ্কোনা গাছের চাষ করে কুইনাইন বানিয়ে পাঠিয়ে নজির গড়েছিলেন তখন। রামব্রহ্মকে কিং পাঠিয়েছিলেন চিড়িয়াখানার পশুদের প্রতিপালনের কাজে।
কথায় বলে, প্রতিভাকে যেখানেই পাঠানো হোক, আলোর ছটা ঠিকই ঠিকরে বেরোবে। ডাক্তারি থেকে পশুদের দেখাশোনার কাজে এসেও নিজের প্রতিভাকে ঠিকই চিনিয়েছিলেন রামব্রহ্ম। ততদিনে চিড়িয়াখানার সরকারিভাবে উদ্বোধন হয়েছে। ১৮৭৫ সালে কলকাতায় এসে উদ্বোধন করে গেলেন ভবিষ্যতের ব্রিটেনের রাজা, ব্রিটিশ ভারতের ভাবী অধীশ্বর, তৎকালীন 'প্রিন্স অফ ওয়েলস' সপ্তম এডোয়ার্ড।
ততদিনে রামব্রহ্মের পদোন্নতি হয়েছে। স্রেফ কাজের সুবাদেই ওপরমহলের বহু তাবড় বিলিতি কর্তাদের নজর কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি। নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতেন। খুঁটিনাটি সবকিছু ছিল তাঁর নখদর্পণে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সেসব লিপিবদ্ধ রাখতেন নিয়মিত। পরে তিনিই নিজ দক্ষতায় আলিপুর চিড়িয়াখানার প্রথম ভারতীয় অধিকর্তার পদে আসেন। এই পদে তাঁর অন্যতম সাফল্য, চিড়িয়াখানার অভ্যন্তরে প্রজনন।
সেকালে না ছিল উন্নত প্রযুক্তি, না ছিল টাকাপয়সা। লন্ডনের পরেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ শহর ও বাণিজ্যকেন্দ্র কলকাতার জন্য ওয়েস্টমিনস্টারের দায় ছিল, কিন্তু দায়িত্ব ছিল না। সেই অবস্থাতেও, স্রেফ নিজ দক্ষতায়, আলিপুর চিড়িয়াখানায় কৃত্রিম প্রজননের ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছিলেন রামব্রহ্ম। তাঁর তত্ত্বাবধানেই ১৮৮৯ সালে একটি সুমাত্রার গণ্ডার জন্ম দেয় শাবকের। কার্যত বৈপ্লবিক ছিল সেই কাজ। পরের ঘটনা একেবারে ১০০ বছর পরের, ২০০১ সালের!
আলিপুর চিড়িয়াখানা এককালে কী ছিল, তা আজকের চেহারা দেখলে বোঝা অসম্ভব! ক্রমশ ঘনবসতিতে ঘিঞ্জি হয়ে ওঠা দক্ষিণ কলকাতায় আজ আলিপুর চিড়িয়াখানার জন্য বাড়তি জমিও পাওয়া মুশকিল। এনক্লোজারগুলোর আধুনিকীকরণ অনেকদিন হয়নি। মানও পড়ে গিয়েছিল অনেক। অথচ স্বাধীনতার আগে দীর্ঘদিন ধরে বাঙালি বিজ্ঞানীদের তত্ত্বাবধানে আলিপুরের চিড়িয়াখানা হয়ে উঠেছিল বিশ্বের অন্যতম খ্যাতনামা চিড়িয়াখানা। সীমিত সামর্থ্যেও আলিপুরে সেই যুগের পক্ষে প্রায় অভাবনীয় উঁচু মান বজায় রাখা হত। কীভাবে সেসব হত, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে রামব্রহ্ম একটি বই লিখেছিলেন, 'আ হ্যান্ডবুক অফ দ্য ম্যানেজমেন্ট অফ অ্যানিম্যালস ইন ক্যাপটিভিটি ইন লোয়ার বেঙ্গল'। তাঁর সেই কাজ কার্যত সাড়া ফেলে দেয় প্রাণীবিজ্ঞানীদের মধ্যে। ১৮৯২ সালের আগস্টে তার 'রিভিউ' ছেপেছিল বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞান-পত্রিকা 'নেচার'।
রামব্রহ্মের আমলে চিড়িয়াখানার খ্যাতি এমনই ছড়িয়েছিল যে, সেকালের বহু নামী ব্যক্তি নিয়মিত আসতেন চিড়িয়াখানায়। এসেছেন স্বামী বিবেকানন্দ, রাশিয়ার জারের পুত্র, হাওয়াইয়ের রাজা, দেশের বড়লাট, বাংলার ছোটলাট, এমনকি কলকাতায় অন্তরীন থাকা অযোধ্যার নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ অবধি আসতেন পশুপাখিদের দেখতে। ওয়াজিদ আলি শাহ তো রামব্রহ্মের কাজে মুগ্ধ হয়ে নিজের বেশ কিছু পোষ্যকে দান করেছিলেন চিড়িয়াখানায়।
রামব্রহ্ম পরে ইউরোপ যান। বহু নামী চিড়িয়াখানায় ঘুরে দেখেন প্রতিপালন ব্যবস্থা। কেমব্রিজে প্রাণিবিদ্যার আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। এশিয়াটিক সোসাইটির 'অ্যাসোসিয়েট' সদস্য করা হয় তাঁকে।
বাঙালি রামব্রহ্ম সান্যালকে মনে রাখেনি। তাঁর অতুল কীর্তিও বিস্মৃতিতে। রয়েছে শুধু তাঁর সৃষ্টি, তাঁর উদ্ভাবনী শক্তির প্রমাণ, আজকের আলিপুর চিড়িয়াখানা। দেশের প্রাচীনতম এই চিড়িয়াখানা আয়তনে খুবই ছোট, স্থান-সংকুলান খুবই সমস্যার। সারা কলকাতাতেও অনেক নতুন পুরনো দেখার জিনিস রয়েছে। অথচ আজ কলকাতার অন্যতম 'আইকনিক', একরকম 'ব্লকবাস্টার' ক্রাউড-পুলার দর্শনীয় স্থান এই চিড়িয়াখানাই। তার প্রতিদ্বন্দ্বী সেভাবে কেউ নেই।
অন্তত সামনের শীতকালে চিড়িয়াখানায় গিয়ে একবারের জন্যও এই বাঙালি পথিকৃৎকে আমরা মনে করব, এইটুকুই শুধু কাম্য।
পিরিয়ডিক টেবিল বাদ পড়ল দশমের ভৌত বিজ্ঞান থেকে, হতবাক বিজ্ঞানের শিক্ষকরা