শেষ আপডেট: 12th August 2022 14:21
দ্য ওয়াল ব্যুরো: সবরমতীর পরই সোদপুর। ভারতীয় ইতিহাসের ভূ-কেন্দ্র। গান্ধীজির 'সেকেন্ড হোম (Gandhi Ashram)।' ফলকে লেখাও রয়েছে সে কথা। এখানেই নেতাজি বৈঠকে বসেছিলেন গান্ধীজি ও নেহেরুর সঙ্গে। তারপরই জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির পদ ছাড়েন তিনি। গান্ধিজির সেই দ্বিতীয় গৃহে এখন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। একসময়ের সাজানো বাগানে আজ অবহেলার ঝোপঝাড়। এই গান্ধী আশ্রমে বহুকাল আগেই বন্ধ হয়েছে খাদি সামগ্রী তৈরির কাজ। ভাঙাচোরা আসবাবের সঙ্গে ঠাঁই হয়েছে বহু পুরোনো তাঁত, চড়কা-সহ বিভিন্ন মূল্যবান ছবি, নথি।
সোদপুর স্টেশন থেকে বেরিয়ে বিটি রোডের দিকে এক মিনিট হাঁটলেই যেখানে উড়ালপুল শেষ হচ্ছে, তার বাঁ দিকেই রয়েছে সরকারি আবাসন। তার ভেতরেই রয়েছে প্রায় বিস্মৃত গান্ধী আশ্রম (Gandhi Ashram)।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সহযোগী, মহাত্মা গান্ধীর স্নেহভাজন সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত বেঙ্গল কেমিক্যালসের চাকরি ছেড়ে ১৯২১ সালে তৈরি করেন এই আশ্রম। গান্ধীর ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে হাতে কাটা চরকায় সুতো, খাদি বস্ত্র, মধু, ধুপকাঠি প্রভৃতি তৈরি শুরু করেন তিনি। আশ্রমের উদ্বোধনে গান্ধীজি, মতিলাল নেহেরু ছাড়া সেই সময়ের জাতীয় স্তরের বিখ্যাত কিছু ব্যক্তি এসেছিলেন। পরে বারবার এখানে এসেছেন গান্ধীজি। বলেছেন, এটি 'দ্বিতীয় গৃহ' নিজের লেখায় এভাবেই বর্ণনা করেছেন সোদপুরের আশ্রমকে।
১৯৩৯ সালের মার্চে গান্ধীজির সঙ্গে এই আশ্রমেই বৈঠকে বসেন সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু। ১৯৪৬ সালের ১০ অক্টোবর লক্ষ্মীপুজোর দিন নোয়াখালিতে দাঙ্গা শুরু হয়। তখন সোদপুরের আশ্রম থেকেই নোয়াখালির উদ্দেশে রওনা দেন জাতির পিতা।
শুক্রবার সোদপুরে গিয়ে দেখা গেল, পৌনে তিন বিঘা জমির উপরে তৈরি গান্ধী আশ্রম নিশ্চল পড়ে আছে। এককালের সাজানো বাগান এখন ঝোপঝাড়ে ভরা। ছাদের টালি বিভিন্ন জায়গায় ভেঙে গিয়েছে। আশ্রমের সব ঘরই তালাবন্ধ।নেতাজি-নেহরু-সহ বিভিন্ন নেতাদের ছবি লাগানো রয়েছে গান্ধী আশ্রমের নোনা ধরা দেওয়ালে। দরজা জানলাও প্রায় ভেঙে পড়ার জোগাড়। চতুর্দিকে আগাছা।
কেন এই হাল? ১৯৭৪ থেকে এই আশ্রমের সচিবের দায়িত্বে প্রবীণ গান্ধীবাদী অসিতরঞ্জন দাস। কলেজস্ট্রিটের খাদি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বেও তিনি রয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, 'কারও আমলেই কিছু হয়নি। এই সরকারও কিছু করছে না। কেন্দ্রেরই সদিচ্ছা নেই। আমরা বহু চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাজ হয়নি।'
জানা গেল, একবার আশ্রমের হাল ফেরানোর দায়িত্ব নিয়েছিল আহমেদাবাদের 'সবরমতী আশ্রম প্রিজার্ভেশন অ্যান্ড মেমোরিয়াল ট্রাস্ট।' কিন্তু অভিযোগ, নরেন্দ্র মোদীর সরকার সোদপুরের গান্ধী আশ্রম সংরক্ষণের প্রকল্পটি বাতিল করেছে।
প্রায় জন্মলগ্ন থেকে একটি হরিজন পরিবার আশ্রিত হিসেবে বসবাস করে আশ্রমে। সেই পরিবারের প্রবীণ সদস্য চেতন রায় দাস বললেন, 'সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত এখানে থাকতে দিয়েছিলেন আমাকে। আমি বিভিন্ন কাজ করতাম। আগে বহু বড় বড় মানুষ আসতেন। এখন কালেভদ্রে কেউ আসে। শুনেছি মোদী সরকার এটা ঠিক করতে আগ্রহী নয়। আমরা চাই এই আশ্রম আবার সেজে উঠুক।'
পানিহাটি পুরসভার কর্মী সুশীল সরকার এখানে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করেন। তিনি আশ্রমের বিভিন্ন অংশ ঘুরিয়ে দেখালেন। এক সময়ে যে ঘরে মহিলারা তাঁত বুনতেন, সেগুলির বেহাল দশা। আলোর ব্যবস্থাও নেই। ভাঙা তাঁত ও যন্ত্রের কাঠামোগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে বিভিন্ন জায়গায়। যে ঘরে গান্ধীজি থাকতেন, সেখানে তাঁর একাধিক ছবি, ব্যবহার করা জিনিস-পত্র, খাট, বিছানা রয়েছে অযত্নে।
তিনি বললেন, 'গেটের সামনে নির্মাণ সামগ্রী ফেলা হয়। সব পড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে গেল। সন্ধে হলে অন্ধকার নেমে আসে। কেউ আসেনা এই আশ্রমে। এখনকার কেউ জানেই না এই আশ্রমের কথা। আমরা চাই দিল্লির সরকার এই আশ্রম সংস্কার করুক। মিউজিয়াম হোক। অনুষ্ঠান হোক।'
সোদপুরের একটি বড় বস্ত্র বিপণীর কর্ণধার জীবনকৃষ্ণ সাহা বিষয়টিতে বললেন, 'একটা ঐতিহাসিক জায়গা। সোদপুরের গর্ব। আগে বাইরে থেকে বহু পর্যটক আসতেন। এখন আর কেউ আসেনা। সংস্কার হলে তো ভালোই হয়। তবে কেন হচ্ছে না, তা নেতারা বলতে পারবেন।'
আশ্রম এখন রয়েছে একটি ট্রাস্টি বোর্ডের হাতে। সেই বোর্ডের অন্যতম পদে রয়েছেন তৃণমূল সংসদ সৌগত রায়। তিনি আশ্রমের বেহাল দশা নিয়ে বললেন, 'গোপালকৃষ্ণ গান্ধী যখন রাজ্যপাল ছিলেন তখন এই আশ্রম সংস্কারের একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আমরা প্রধামমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। পর্যটন মন্ত্রকেও চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু কেন্দ্রের তরফে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এটা বাংলায় মহাত্মা গান্ধীর দ্বিতীয় গৃহ ছিল। এটা সংস্কার করে বড় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে। কিন্তু রাজ্য সরকারের অত টাকা নেই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে উদ্যোগ নিয়ে বেলেঘাটার গান্ধী ভবন সংস্কারের ব্যবস্থা করেছেন। এটার বিষয়েও আমি মুখ্যমন্ত্রীকে বলব।'
সোদপুরের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গান্ধী আশ্রমে নানা সময়ে এসেছেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় থেকে ইন্দিরা গান্ধী, আন্তর্জাতিক বেশ কিছু শীর্ষ রাষ্ট্র প্রতিনিধি।
সামনেই স্বাধীনতা দিবস। ৭৫ বছরের উদযাপন এবার অনেক বড়। কেন্দ্রীয় স্তরে একাধিক বর্ণাঢ্য কর্মসূচী। এবার আর ক্লাবে-প্রতিষ্ঠানে নয়, ঘরে ঘরে উঠবে জাতীয় পতাকা। কিন্তু ওই দিনেও হয়ত একটা একহারা মালাও কেউ দেবে না সোদপুরের বিস্মৃত আশ্রমের গান্ধীজির মূর্তিতে।