শেষ আপডেট: 22nd May 2022 11:53
দ্য ওয়াল ব্যুরো: দু'দিন আগেও ফেসবুকের দেওয়ালে একটি পোস্ট ঘুরছিল, চন্দননগরের তরুণী পিয়ালী বসাকের (Piyali Basak) এভারেস্ট অভিযান নিয়ে। এভারেস্ট ও তার পার্শ্ববর্তী শীর্ষ লোৎসে-- এই দুই শৃঙ্গ আরোহণের অভিযানে গেছেন পিয়ালী। কিন্তু এভারেস্ট আরোহণের জন্য কাঙ্ক্ষিত অর্থ জোগাড় হয়নি। অর্থাৎ যে অর্থ কাঠমান্ডুতে আরোহণ আয়োজনকারী সংস্থার হাতে তুলে দিতে হয়, তা দেওয়া যায়নি। ফলে অনুমতি মেলেনি আরোহণের। অর্থসাহায্য চেয়ে ফেসবুক পোস্ট করেছিলেন তাঁর পরিবার। শেষমেশ শনিবার সন্ধেয় খবর আসে, সামিট ক্যাম্প থেকে শৃঙ্গের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন পিয়ালী। আজ রবিবার, সকালেই এল সুখবর। জানা গেল, এভারেস্ট ছুঁয়েছেন তিনি।
আর পাঁচটা এভারেস্ট অভিযানের চেয়ে অনেকটাই আলাদা ছিল ৩৪ বছর বয়সি তরুণী পিয়ালীর (Piyali Basak) এই অভিযান। কারণ তিনি এই শৃঙ্গে গিয়েছেন অতিরিক্ত অক্সিজেন সাপ্লিমেন্ট ছাড়াই। উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বায়ুর চাপ কমে আসে বলে, অতিরিক্ত উচ্চতায় অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়া শ্বাস নিতে খুবই কষ্ট হয়। মোটামুটি সাড়ে ছ'হাজার-সাত হাজার মিটার উচ্চতা থেকেই শুরু করতে হয় অক্সিজেন নেওয়া। সেখানে এভারেস্ট ৮৮৪৮ মিটার উঁচু। এই উচ্চতায় অক্সিজেন ছাড়া আরোহণ করা যথেষ্ট কঠিন। জানা গেছে, সেই কঠিন কাজই করে ফেলে রেকর্ড গড়েছেন পিয়ালী বসাক। প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে বিনা অক্সিজেনে এভারেস্ট সামিট করলেন তিনি, এমনটাই জানাচ্ছে কাঠমাণ্ডুর এজেন্সি। পরবর্তী শৃঙ্গ লোৎসে সামিট হলে তা হবে আরও এক রেকর্ড।
কিন্তু পিয়ালীর (Piyali Basak) এই আরোহণ অনেক বিতর্কও উস্কে দিয়েছে পর্বত-অভিযাত্রী মহলে। পিয়ালী ২০১৯ সালেও এভারেস্ট অভিযানে গিয়েছিল। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের মাথায় তখনই চেপেছিল ঋণের বোঝা। তার উপরে আরও অনেকটা ঋণ নিয়েই এবছর আবার ছুটেছেন তিনি বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের পথে। বারবার বলেছেন, টাকার অভাবে খুব ভাল মানের ইকুইপেন্ট বা পোশাক তিনি জোগাড় করতে পারেননি। কিন্তু এভারেস্ট তিনি ক্লাইম্ব করতে চান যে কোনও ভাবেই। প্রশ্ন উঠেছে, এতটা ঋণ করে, জিনিসপত্রের সঙ্গে আপস করে এত দুর্গম একটা অভিযান কি সত্যিই প্রয়োজনীয়?
অভিজ্ঞ পর্বতারোহীরা বলে থাকেন, পর্বতারোহণ কোনও প্রতিযোগিতা নয়। এখানে কেউ কারও প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। একজনকে টপকে আরেকজনকে যে দ্রুত এগিয়ে যেতে হবেই, পুরোনো রেকর্ড ভেঙে নতুন কিছু করতেই হবে-- এটাই পর্বতারোহণের মোক্ষ নয়। ঋণের ওপর ঋণের বোঝা, ঝুঁকির ওপর ঝুঁকি নেওয়া-- এ যেন খানিক গায়ের জোর দেখানো, যা দিয়ে পর্বতারোহণের মতো কঠিনতম ও রাজকীয় স্পোর্টসে সাফল্য আসা কঠিন।
তবে পিয়ালীর (Piyali Basak) সামিটের খবর আসার পরে এইসব যুক্তি যেন ফিকে হয়ে গেছে। যেনতেনপ্রকারে টাকার বন্দোবস্ত করে, শেষ মুহূর্তে আরোহণের অনুমতি বার করে, বিনা অক্সিজেনেই তিনি এভারেস্ট ছুঁয়ে ফেলেছেন বলে জানা গেছে। দু'বছর আগে কয়েকশো মিটার দূরে যে শীর্ষ অধরা থেকে গেছিল, এ বছর তা পায়ের তলায়।
তার মাঝে অবশ্য গত বছর গতবছর অক্টোবর মাসে পৃথিবীর সপ্তম উচ্চতম শৃঙ্গ, নেপালের মাউন্ট ধৌলাগিরি পর্বতের শিখর ছুঁয়েও নতুন রেকর্ড করেছেন পিয়ালী (Piyali Basak)। কারণ সেই শৃঙ্গেও কৃত্রিম অক্সিজেনের সাপোর্ট ছাড়াই আরোহণ করেছেন তিনি। এভাবে এই পাহাড়ের চুড়ো ছোঁয়া প্রথম মহিলা পর্বতারোহী তিনিই। তার আগে ২০১৮ সালে পিয়ালী শিখর ছুঁয়েছিলেন বিশ্বের অষ্টম উচ্চতম শৃঙ্গ মানাসলু-র। এই চূড়ায় উঠতে গিয়ে বিশ্বের বহু পর্বতারোহীর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সেখানে সাফল্যের মাইলফলক গেঁথে এসেছেন পিয়ালী।
পাহাড়ের প্রতি এই নেশা বা টান অবশ্য আজকের নয়। ছোটবেলায় স্কুলের বইয়ের পাতায় ছোট্ট করে এভারেস্ট অভিযানের কাহিনি পড়ার পর থেকেই পাহাড়ের প্রতি টান তৈরি হয়েছিল স্কুলপড়ুয়া পিয়ালীর। তেনজিং নোরগে, এডমন্ড হিলারিরা যেভাবে পৃথিবীর সর্বচ্চ চূড়ায় উঠেছিলেন, সেই কাহিনি রোমাঞ্চিত করেছিল তাকে। এর পরে মা-বাবার হাত ধরে মাত্র ছ’বছর বয়স থেকেই শুরু ট্রেকিং। পাহাড়ে ওঠার নেশা পেয়ে বসে তাঁকে সেই থেকেই।
কিন্তু সেদিন কে জানত, পাহাড় চড়েই সেই মেয়ে (Piyali Basak) একদিন নতুন অধ্যায় যোগ করবে এদেশের পর্বতারোহণের ইতিহাসে!
চন্দনগরের তরুণী পিয়ালী বসাক (Piyali Basak) পেশায় স্কুলশিক্ষিকা, কানাইলাল প্রাথমিক স্কুলে চাকরি করেন তিনি। নেশায় পুরোদস্তুর পর্বতারোহী। সেই আরোহণের নেশাতেই একের পর এক শৃঙ্গে অভিযান চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। আর্থিক সমস্যা, সামাজিক বাধা– কোনও প্রতিকূলতাই তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি ঘরে। বারবারই পাহাড়ের বুকে রুদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছেন, তাঁকে থামাতে পারেনি কোনও কিছুই। ২০০০ সালের ১ আগস্ট অমরনাথ যাত্রায় গিয়ে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন ভয়াবহ জঙ্গিহানা। কেদারনাথে গিয়ে মেঘভাঙা বৃষ্টি, তুষারধস থেকে জীবন হাতে করে বেঁচে ফিরেছিলেন। আরও বহু তীর্থযাত্রীকেও বাঁচিয়েছিলেন সেই সঙ্গে। এইভাবেই যেন পাহাড়ের সঙ্গে আরও নিবিড় এক সম্পর্ক তৈরি করেছেন তিনি।
শুধু পাহাড় চড়াই নয়, খুব ভাল আঁকতেও পারেন তিনি। মার্শাল আর্টসে ব্ল্যাকবেল্ট, দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্বও করেছেন। বরফে স্কি করারও দুরন্ত দক্ষতা, এ রাজ্যের প্রথম মহিলা স্কিয়ার তিনিই।
পিয়ালীর (Piyali Basak) পরিবারে অবশ্য আছে নানা সমস্যা। বাবা তপন বসাক অসুস্থ, তাঁকে নিয়ে প্রায়ই পিয়ালীকে। দৌড়োদৌড়ি করতে হয় হাসপাতালে। বাড়ির দোকান-বাজার ও অন্যান্য কাজ সামলানোর দায়িত্বও তাঁরই। পাহাড়ে চড়তে গিয়ে ঋণ হয়েছে কয়েক লক্ষ টাকা, আছে সেসব মেটানোর দায়ও। কিন্তু তার পরেও হাল ছাড়েননি পিয়ালী। ছেলেবেলায় সেই বইয়ে পড়া এভারেস্ট অভিযানকে পাখির চোখ করেছিলেন। স্বপ্ন সত্যি করে ইতিহাস লেখার সে যাত্রা যেন সফল হল শেষমেশ।
এবার বাকি লোৎসে শৃঙ্গ। সব ঠিক থাকলে আজই সামিট ক্যাম্প থেকে সেই শৃঙ্গের পথে রওনা দেবেন পিয়ালী (Piyali Basak), কৃত্রিম অক্সিজেনের সাপোর্ট ছাড়াই। সেক্ষেত্রে কাল সকালেই আসতে পারে আরও একটা সুখবর। আর তা যদি আসে, ভারতীয় পর্বতারোহণের আঙিনায় এক নয়া মাইলফলক যোগ হবে।
দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছেন পিয়ালী, এভারেস্ট ছোঁয়ার স্বপ্ন সত্যি করতেই হবে!