শেষ আপডেট: 18th December 2018 01:24
'হ্যাভলক আইল্যান্ডের আতঙ্ক ভোলার নয়', ফিরে এসে ভয়ানক দিনগুলির কথা জানালেন কল্যাণীর এই দম্পতি
গৌতমী সেনগুপ্ত
আন্দামানের হ্যাভলক আইল্যান্ডের নীল জল আর তাঁদের টানছে না। জাহাজে চড়ে সমুদ্রের মজা এখন ফিকে। চোখ বন্ধ করলেই মনে পড়ে যাচ্ছে সেই বন্ধ গেট, পকেট খালি হয়ে যাওয়ার ভয়। তাঁদের কাছে এখন আতঙ্কের নাম হ্যাভলক আইল্যান্ড। যেখানে টানা তিন দিন আটকে পড়েছিলেন নদিয়ার কল্যাণীর বাসিন্দা মালা ও চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়। কীভাবে কাটিয়েছেন এক একটা দিন ! মনে করলেই আঁতকে উঠছেন এই প্রবীণ দম্পতি। জনালেন, 'রোজ ফেরার আশায় পোর্টে আসতাম, আর সারাদিন কাটিয়ে রাতে হোটেলের খোঁজ করতাম। এই বয়সে এতটা অনিশ্চয়তার মধ্যে কোনওদিনই পরিনি। '
উদ্ধার হওয়া পর্যটকরা
গত সপ্তাহেই সমুদ্রে গভীর নিম্নচাপের ফলে পোর্ট ব্লেয়ার-হ্যাভলক আইল্যান্ডের জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে দ্বীপেই আটকে পড়েন কয়েক হাজার পর্যটক। এর মধ্যেই ছিলেন মালা ও চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়। যাঁরা ১১ ডিসেম্বর আন্দামানে আসেন। ১৩ ডিসেম্বর ঘুরতে যান হ্যাভলকে। সেই রাতেই খবর আসে হ্যাভলক থেকে ছাড়ছে না কোনও জাহাজ। এমনকী পোর্ট ব্লেয়ার থেকেও কোনও জাহাজ বা বোট হ্যাভলকে আসতে পারছেনা।এর কারণ, সমুদ্রে গভীর নিম্নচাপ। যে কোনও সময়ে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়তে পারে জাহাজগুলি। তাই আপাতত বন্ধ সমস্ত জাহাজ পরিষেবা। শুনেই পর্যটকদের আনন্দ হাহাকারে পরিণত হয় বলে জানাচ্ছেন মালা মুখোপাধ্যায়। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে ১২০০ জনই ছিলেন বাঙালি। যাঁরা প্রত্যেকেই অজানা ভয়ে দ্বীপেই দিন-রাত যাপনে সামিল হন।
হ্যাভলকের একটি দ্বীপ
কীভাবে কেটেছে তিনটে দিন ? মালা দেবী জানাচ্ছেন, ১৩ ডিসেম্বর কোনওরকমে কাটলেও ১৪ তারিখ থেকে শুরু হয় লড়াই। রোজ ব্যাগ, সুটকেশ নিয়ে হোটেল থেকে চেক আউট করে হ্যাভলক পোর্টে যেতেন দম্পতি। সারাটাদিন পোর্টে কাটিয়ে শেষ উত্তর আসত, ' না, আজকেও জাহাজ ছাড়া হবে না।' আবার ফেরা। কিন্তু কোথায়? পোর্টে রাত কাটানোর মতো শারীরিক অবস্থা নেই, তাই আবার হোটেল খোঁজার পালা। এভাবেই রোজ বিভিন্ন হোটেলে চেক-আউট, চেক-ইন চলতে থাকে। কিন্তু উত্তর আসে না। সমুদ্রও যেন দাঁত বার করে তার তেজ বাড়াতে থাকে।
রাতে হ্যাভলকের পোর্টে পর্যটকদের ভিড়
কীভাবে ফেরার ছাড়পত্র মিলল ? প্রায় হাতে পায়ে ধরে পোর্ট কর্তৃপক্ষকে রাজি করান মালা দেবী। তিন দিন কেটে যাওয়ার পর ১৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় জাহাজ পরিষেবা। তবে হাতে গোনা জাহাজ, বোট থাকায় সুযোগ কার কখন আসবে সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে ওঠে। পোর্টে এর ফলে দফায় দফায় অরাজকতাও শুরু হয়। মালা দেবী জানাচ্ছেন,' অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। কারণ হ্যাভলকে থাকার মতো টাকা তাদের কাছে ছিল না। হোটেল থেকে খাবার সবই চড়া দামের। দ্বীপে কয়েকটাদিন কাটিয়েই স্রেফ পকেট খালি হয়ে যায় বেশিরভাগের।' সেই আতঙ্কে ছিলেন মালা দেবীর স্বামী চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়ও। জানাচ্ছেন, 'আর দুটো দিন থাকতে হলে আমরাও বিপদে পড়তাম।'
সকালেও সেই ভিড়
সে যাই হোক, অবশেষে বাজল ছুটির ঘণ্টা। ১৬ ডিসেম্বর একটি বিশাল সরকারি জাহাজে জায়গা করে নিলেন মুখুজ্জে দম্পতি। মঙ্গলবারই পোর্ট ব্লেয়ার থেকে সকাল সাড়ে আটটার ফ্লাইটে কলকাতা ফিরেছেন তাঁরা। হ্যাভলক থেকে জাহাজে পোর্ট ব্লেয়ার আসতে সময় লাগে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। ১৬ ডিসেম্বর গভীর নিম্নচাপ ছিল বঙ্গোপসাগর জুড়ে। রেশ পড়েছিল ভারত মহাসাগরেও। মালা দেবী জানাচ্ছেন, ফেরার সময়ও সমু্দ্রের গর্জন ছিল ভয় পাওয়া মতোই। ১৮ ডিসেম্বর অর্থাৎ আজকেও হ্যাভলক থেকে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে পর্যটকদের। সুস্থ অবস্থায় একে একে সব পর্যটকই ফিরছেন পোর্ট ব্লেয়ারে। যদিও মুখুজ্জে দম্পতির আতঙ্ক এখনও কাটেনি। বলেই ফেললেন, 'আন্দামান আর না'।