শেষ আপডেট: 6th March 2020 09:23
দ্য ওয়াল ব্যুরো: অসভ্যতা, অপসংস্কৃতি, নাকি রুচির নগ্ন বহিঃপ্রকাশ! কী দেখা গেল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দোল উৎসবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরই গানের লাইনের সঙ্গে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে ( এই ভাষা ব্যবহার করে এই গান গেয়েছিলেন ইউটিউবার রোদ্দুর রায় ) চার তরুণীর পিঠে আবির দিয়ে দিয়ে লিখে ছবি তোলা হল। আর সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে ভাইরাল হল সেই ছবি। শুরু হল সমালোচনা, ধিক্কার। বাংলার সংস্কৃতিকে কালিমালিপ্ত করার অভিযোগ উঠল বর্তমান প্রজন্মের উপর।
এই ঘটনার পরে ক্ষোভে ফুঁসছে বাঙালি। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে 'ছেলেখেলা' কোনও মতেই বরদাস্ত নয় তাদের। দাবি উঠেছে অভিযুক্তদের শাস্তির। অবশেষে চাপে পড়ে তাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অভিযুক্ত চার তরুণী ও ফটোগ্রাফার নাকি এই কাজের জন্য ক্ষমাও চেয়েছে। কিন্তু তাতেও ক্ষোভের আগুন কমেনি। বারবার এই ধরনের ঘটনার প্রতিবাদ করছেন সবাই।
এই সময়ে কী বলছে বাংলার সংস্কৃতি জগত। দ্য ওয়াল-এর তরফে যোগাযোগ করা হয়েছিল বাংলা সঙ্গীত জগতের ছয় বিখ্যাত গায়ক-গায়িকা-সুরকারের সঙ্গে। এই ঘটনা নিয়ে কী বললেন তাঁরা।
দেবজ্যোতি মিশ্র: পুরুষের সমাজের কতগুলো সিম্বল ক্যারি করেছেন মেয়েরা। এই ঘটনাটাতে মনে হল, পুরুষতান্ত্রিক যৌনতাকেই তো তুলে ধরছেন তাঁরা। মেয়েরা পুরুষতন্ত্রের কিছু স্টক সিম্বল বহন করছেন, তা দিয়ে কি আদৌ কিছু এগোনো সম্ভব! রবীন্দ্রনাথ প্রখর ও প্রবল তারুণ্যের প্রতীক। তাকে ছেদ করে যেতে গেলে আরও শক্তপোক্ত ভাবনার প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের মূল যে সুরটা, সেই সুরটা একটা অনন্ত যৌবন। তাকে যৌবনোদ্দীপ্ত করতে পারার মতো এটা কোনও মুভমেন্ট না। নবারুণ পড়া যায়, কিন্তু তার গভীর অর্থ বুঝে একটা ফ্যাতাড়ু সমাজ তৈরি করতে পারা কি আর সম্ভব! যা দেখলাম, তাতে আমার মনে হয়নি, এটাতে রবীন্দ্রনাথের চেয়েও শক্তপোক্ত একটা প্যারালাল সংস্কৃতি তৈরি হতে পারে!
শ্রাবণী সেন: আমি তো অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমি ধিক্কার জানাচ্ছি। এদের বয়কট করা উচিত। ছেলেমেয়েরা এত অসভ্য হয়ে গেছে যে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নামই খারাপ করছে, সেটা বুঝতে পারছে না। ছিঃ ছিঃ ছাড়া আর কিছু বলার নেই।
রূপঙ্কর বাগচী: আজকালকার ছেলেমেয়েদের অনেক ক্ষেত্রেই আমি খুব একটা বুঝতে পারি না। এটা বোধহয় রোদ্দুর রায়ের কোনও একটা লিরিক থেকে গাওয়া। আজকালকার ছেলেমেয়েদের এটুকুই বলব যে রেবেল হওয়া আলাদা, আর অসভ্যতামি আলাদা। আমরা যে সময়ে বাস করছি সে সময়ে বিপ্লব করা বা প্রতিবাদ করা খুবই দরকার। কিন্তু তার মানে অসভ্যতামি নয়। যদি এখন উত্তরপ্রদেশ বা বিহারের ছেলেমেয়েদের মতো অবস্থা বাঙালিদের হয় তাহলে আর দুঃখের কিছু থাকবে না। আমি খুব একটা অবাক হয়নি। কারণ বিভিন্ন কলেজে তো অনুষ্ঠান করতে যাই। এখনকার ছেলেমেয়েদের দেখেছি তারা কোনও কিছুর পরোয়া করে না। পরোয়া না করা ভাল, কিন্তু তার মধ্যে একটা মার্জিত ভাব থাকা দরকার। আর রবীন্দ্রভারতীতে পড়ছ, রবীন্দ্রনাথ যদি এটা লিখতেন, তাহলে ঠিক ছিল। কিন্তু তিনি তো এটা করেননি। রোদ্দুর রায়ের মতো যারা অন্য ধরনের কথা বলছেন, তাঁদের অশ্রদ্ধা না করেই বলছি, এই ধরনের কথা না বলে যদি বিপ্লবের কথা বা অন্য কাজের কথা বলতেন, তাহলে ভাল হত। এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আশা করি ছেলেমেয়েরা এটা বুঝতে পেরে নিজেরাই কষ্ট পাচ্ছে। আর যদি তারা না বুঝতে পেরে ভাবে বেশ করেছি, তাহলে কিন্তু খুব বিপদ।
লোপামুদ্রা মিত্র: এই বিষয়টা যে জায়গায় যাচ্ছে, আমার মনে হয় এই নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখানোই উচিত না। কারণ এই ধরনের অসভ্যতামি যত প্রচার করা হয়, আমার মনে হয় তা আরও বাড়ে। তাই আমার মনে হয় এদের মানুষ হিসেবেই গণ্য করা উচিত নয়।
সুজয় প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়: আমি জানি না কোন পরিপ্রেক্ষিতে এটা করা হয়েছে। কিন্তু যদি এটা কোনও রাজনৈতিক দল, বা সমাজের কোনও বিষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রেও এটা যথেষ্ট কুরুচিকর। কারণ আমার কাছে এটা প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না। আজকালকার দিনে অনেকেই একে প্রতিবাদ হিসেবে দেখেন। কিন্তু এটা ঠিক নয়। আমার কাছে এটার কোনও মূল্য নেই। আমার মনে হল যত রকমের গালাগাল জানি তার একটা প্রদর্শনী করে দিলাম। রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে বিশ্বের যে কোনও প্রান্তেই প্রতিবাদ জানানো যায়। কিন্তু এভাবে নয়।
ইমন চক্রবর্তী: আমার এদেরকে কিচ্ছু বলার নেই। আমরা যখন জোড়াসাঁকো ক্যাম্পাসে পড়াশোনা করেছি এগুলো কোনওদিন হয়নি, আমরা হতেও দিইনি। অসভ্যতা ও অপসংস্কৃতির চরমতম জায়গায় পৌঁছে গেছে এরা। রবীন্দ্রনাথের নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা হতে পারে, আমি ভাবতেও পারি না। এদের কোনও সেন্স নেই। কী ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে এরা পড়ছে সেটাই বুঝতে পারছি না। ঘৃণ্য ঘটনা। এতে অপমান হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তণী হিসেবে আমি লজ্জিত।
এটা কিন্তু প্রথম ঘটনা নয়। গত বছর ডিসেম্বর মাসে বিশ্বভারতীর কলা ভবনে দু'দিন ধরে চলা নন্দন মেলায় রোদ্দুর রায়ের এই একই গান গাইতে দেখা গিয়েছিল বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রীকে। তখনও বিতর্ক হয়েছিল। এবার রবীন্দ্রভারতীতেও দেখা গেল একই ছবি। আর এই ছবিগুলো কিন্তু বারবার করে প্রশ্ন তুলছে বাংলার সংস্কৃতির দিকে। প্রশ্ন তুলছে সংস্কৃতি জগতও।