'মারব এখানে...' মিঠুন-বচন কি তাপসের হুমকি মনে করিয়ে দিচ্ছে! কী বলছেন আইনজীবীরা
তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
অভিনয় জগতে তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। তাই ভোটের ময়দানেও সেই পর্দার 'এমএলএ ফাটাকেষ্ট'কে দেখতে বেজায় ভিড় হয়েছিল। সেখানেই তিনি বলেছিলেন সিনেমার সেই আইকনিক সংলাপ, 'মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে'। মানুষভরা মাঠ ফেটে পড়েছিল
অভিনয় জগতে তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। তাই ভোটের ময়দানেও সেই পর্দার 'এমএলএ ফাটাকেষ্ট'কে দেখতে বেজায় ভিড় হয়েছিল। সেখানেই তিনি বলেছিলেন সিনেমার সেই আইকনিক সংলাপ, 'মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে'। মানুষভরা মাঠ ফেটে পড়েছিল হাততালিতে। হবে নাই বা কেন, মিঠুন চক্রবর্তী বলে কথা। রক্তজল করা দৃষ্টি আর বুক কাঁপানো সংলাপে কত বছর ধরে আবিশ্বের ফিল্মপ্রিয় জনতার মনোরঞ্জন করছেন। সেই মিঠুনই ভোট প্রচারে সামনে থেকে বলছেন জনপ্রিয় ডায়ালগ, একেবারে লাইভ! মাঠ তো হাততালিতে কাঁপবেই!
এই মাঠকাঁপানো ডায়ালগই কাল হল। বিপত্তি ঘনাল আজ, মিঠুন চক্রবর্তীর জন্মদিনে। হিরো আজ ৭০ পেরিয়ে ৭১-এ পা দিলেন। আর আদালত নির্দেশ দিল, ওই মন্তব্য উস্কানিমূলক ছিল কিনা তা নিয়ে মিঠুন চক্রবর্তীকে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের। বাংলায় ভোট পরবর্তী হিংসায় তা ইন্ধন জুগিয়েছে। এর পর মামলা খারিজের আবেদন নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থও হয়েছেন মিঠুন। সূত্রের খবর, তখনই অভিনেতাকে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত।
এইখানেই প্রশ্ন উঠেছে, আইনের মানদণ্ডে ঠিক কতটা অপরাধ করেছেন মিঠুন চক্রবর্তী? সিনেমার ডায়ালগের ব্যবহার কি সত্যিই উস্কানিমূলক? নাকি সিনেমার ডায়ালগ পর্দার বাইরে এলে তার বিচার অন্য! নাকি এ কেবলই প্রতিহিংসামূলক কোনও প্রতিক্রিয়া শাসকদলের!
ফিরে যাওয়া যাক কয়েক বছর আগে। ২০১৮ সাল। তাপস পাল তখন রাজনীতির আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র। প্রিয় নায়ক হিসেবে পর্দা মাতানোর বয়স আর না থাকলেও, প্রিয় অভিনেতা হিসেবে তখনও আপামর বাঙালি দর্শকের মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল তিনি। সেই তাপস পালকে ঘিরে উন্মাদনার শেষ নেই। সেই সময়েই কোনও এক নির্বাচনী প্রচারেই তাপস পাল বলে বসেছিলেন, "আমি চন্দননগরের মাল! ঘরে ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে দেব, রেপ করে চলে যাবে!"
এ নিয়ে যে জল কতটা ঘোলা হয়েছিল, তা অনেকেরই মনে আছে। এফআইআর, মামলা-মোকদ্দমার ঝড় পার করে শেষমেশ ক্ষমা চেয়েছিলেন তিনি। সেই তাপস পাল আজ মারা গেলেও, তাঁর এই কটূক্তি এখনও যেন রাজনীতির অঙ্গনে এক বেঞ্চমার্ক হয়ে আছে। মুখের কথা একবার বেরিয়ে গেলে, তা যে আর ফেরানো যায় না, তার অন্যতম উদাহরণ হয়ে থেকে গেছে এই অশ্লীল হুমকি।
মিঠুনের ক্ষেত্রেও কি সমস্যা ততটাই জোরদার?
মিঠুন চক্রবর্তীর আইনজীবী অবশ্য জানিয়েছেন, তাঁর মক্কেল কেবলমাত্র সংলাপ বলেছেন। তা বাস্তবে প্রয়োগের কোনও ইচ্ছে বা মতলব ছিল না তাঁর। তিনি চাননি এই মুখের কথাকে সত্যি ধরে নিয়ে কেউ হিংসা ছড়াক।
ঠিক এই কথাই বলছেন আইনজীবী অনির্বাণ গুহ ঠাকুরতা। পার্কস্ট্রিটের সুজেট ধর্ষণ মামলায় লড়া এই আইনজীবীর কথায়, "সিনেমার সংলাপ যাই হোক না কেন, তা পর্দায় ব্যবহার করাটা অপরাধ নয়। কিন্তু পর্দার বাইরে এই সংলাপ ব্যবহার করা হলে তা কী উদ্দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। সংলাপের থেকেও বড় হয়ে ওঠে সংলাপের ইনটেনশন।"
তিনি জানালেন, প্রকাশ্য মঞ্চে যদি কোনও সংলাপ কেউ ভয় দেখানোর জন্য ব্যবহার করেন বা সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়ার জন্য ব্যবহার করেন, সেটা নিশ্চিত রূপে আইনের চোখে অন্যায়। 'ফ্রিডম অফ স্পিচ' শিল্পের ক্ষেত্রে বা সৃষ্টির ক্ষেত্রে যতটা, ততটাই বাস্তবেও নয়, সঙ্গত কারণেই। ফলে সিনেমার কোনও সংলাপ যদি বাস্তবে মানুষের মধ্যে কুপ্রভাব ফেলে, তাহলে তা আইনত দণ্ডণীয়।
তাঁর কথায়, "মিঠুন চক্রবর্তীর ক্ষেত্রে এই বিষয়টিই বিচার করে দেখতে হবে, যে মিঠুনবাবু কোন ইনটেনশনে সংলাপটা বললেন। আদালতও সেই নির্দেশই দিয়েছে, তাঁর ইনটেনশন তদন্ত করে দেখতে। তদন্তে যদি সামনে আসে তিনি কোনও ক্ষতির উদ্দেশে, চাপ দেওয়ার উদ্দেশে সংলাপটি ব্যবহার করেছেন, তবে সেই মতো চার্জশিট গঠন হবে। কিন্তু তদন্ত যদি বলে উনি নিছক মজার ছলেই ব্যবহার করেছেন সংলাপটি, তাহলে এই মামলা বাতিল হতে পারে।"
আইনজীবী সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় আবার জানাচ্ছেন, যে কোনও সংলাপই ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, স্থান, কাল এবং পাত্র। কে, কোথায়, কী বলছেন, সেটাই আইনের চোখে বিচার্য। তিনি বলছেন, "আজ পাড়ার মোড়ে কেউ 'মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে' এই কথা বলে কাউকে চমকালেন সেটা একরকম। কিন্তু একটি সুবিশাল রাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে এই একই কথা বলেন কোনও নেতা, তখন তাতে উস্কানি ছড়ানোর সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। সেটা আইনের চোখে অন্যায়। তাই এক্ষেত্রে ওই নেতার দায়িত্ব অনেকটাই বেশি থাকে, তাঁর ব্যবহার করা কোনও কথা বা সংলাপের জের কী হতে পারে। এখানে মিঠুন চক্রবর্তী মঞ্চে দাঁড়িয়ে নায়ক হিসেবে নয়, একজন নেতা হিসেবেই বক্তৃতা রাখছেন। তাঁর সত্বাটাই আলাদা। তাই সেখানে তাঁকে অনেক বেশি সচেতন থাকতে হবে।"
সব্যসাচীবাবু মনে করিয়ে দিলেন, এই কারণেই তাপস পালের বিরুদ্ধেও এফআইআর দায়ের হয়েছিল 'ঘরে ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে দেব' মন্তব্যের জন্য। এই মন্তব্য সিনেমায় ব্যবহার হলে কেউ এফআইআর করত না নিশ্চয়, সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র নিয়েই সেই সংলাপ পর্দায় উচ্চারিত হতো।
"ফলে কে, কোথায়, কী বলছেন, কেন বলছেন, সেটাই আইনের চোখে বিচার্য। মিঠুন চক্রবর্তীর ক্ষেত্রে হয়তো রাজ্য সরকার খানিকটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিরোধিতা করছে, কিন্তু রাজনীতির মঞ্চে মিঠুন চক্রবর্তীর ওই সংলাপের ব্যবহারও ন্যায়সুলভ নয়। নেতার মুখে এই কথা ৫০৬ ধারার আওতায় আসতে পারে।"-- বললেন সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়।