মৃতদেহের আবার ধর্ম কী! নব্বইয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে অহিন্দুর দেহও বহন করছে হিন্দু সৎকার সমিতি
সুকমল শীল
মৃতের কোনও ধর্ম হয় না, বলছে সংগঠন। তাই নব্বই পেরনোর মুখে এসে রীতি বদল করা হয়েছে। করোনা অতিমারিতে মৃত অহিন্দুর দেহও গোরস্থানে নিয়ে যাচ্ছে হিন্দু সৎকার সমিতি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রায় ৪০০টি মৃতদেহ সৎকার করেছে এই সংগঠন। এখন মোট
মৃতের কোনও ধর্ম হয় না, বলছে সংগঠন। তাই নব্বই পেরনোর মুখে এসে রীতি বদল করা হয়েছে। করোনা অতিমারিতে মৃত অহিন্দুর দেহও গোরস্থানে নিয়ে যাচ্ছে হিন্দু সৎকার সমিতি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রায় ৪০০টি মৃতদেহ সৎকার করেছে এই সংগঠন। এখন মোট ৫টি শববাহী গাড়ি চলছে। এরমধ্যে ২টি গাড়ি শুধুই কোভিডের মৃতদেহ বহন করছে। দিন-রাত কাজ করছেন সংস্থার ১০ কর্মী।
খাতায় কলমে সংস্থার যাত্রা শুরু যদিও ১৯৩২ সালে। কিন্তু কাজ শুরু হয়েছিল আরও এক যুগ আগে থেকে। অর্থাৎ ১৯১৮-’১৯ নাগাদ। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শহরের মতো কলকাতাতেও থাবা বসিয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লু। মহামারী কেড়ে নিয়েছিল অগুনতি প্রাণ। মৃতদেহ সৎকার ছিল মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। সেই সময় হিন্দু মহাসভার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মৃতদেহ সৎকারের কাজে হাত লাগিয়েছিলেন ইন্দুভূষণ বিদ, অনিল রায়চৌধুরী, সনৎ রায়চৌধুরী মতো শহরের কতিপয় যুবক।
মহামারি থামলেও হিন্দু দেহ সৎকারের কাজ চলতে থাকে। ১৯৩২-এ হিন্দু সৎকার সমিতি হিসাবে নাম রেজিস্ট্রি হয় সংস্থার। সেই কারণে, ১৯১৮ নয়, তাঁরা ১৯৩২-কেই জন্ম সাল ধরেন, বলছিলেন সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক চন্দন ঘোষ। অর্থাৎ বছর দশেক পর শতবর্ষে পা রাখবে মহাত্মা গান্ধী রোডে অবস্থিত শহরের এই সংস্থাটি। তাদের ওয়েবসাইটে সংস্থার উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্টই বলা আছে দরিদ্র, অসহায়, নির্বান্ধব হিন্দুর মরদেহ সৎকার করার জন্যই সমিতির যাত্রা শুরু। সম্ভবত, দেশে এমন প্রতিষ্ঠান এই একটিই, জানাচ্ছেন সমিতির কর্তারা।
চন্দনবাবু জানান, দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এই প্রথাই এতদিন চলে আসছিল। যেমন রাজ্যের প্রাক্তন রাজ্যপাল নুরুল হাসানের দেহ বহন করার জন্য আমাদের ডাকা হয়েছিল।’ আরও বললেন, পুলিশ ও পুরসভা যে অজ্ঞাত পরিচিতের দেহ সৎকারের দায়িত্ব দেয় সেগুলিতেও অহিন্দু মানুষ থাকতেই পারেন। কিন্তু সাধারণভাবে হিন্দুর দেহ সৎকারের কাজই সমিতি করে থাকে। কিন্তু করোনাকালে সেই ধারায় বদল ঘটানো হয়েছে।’ তিনি বলেন, করোনায় আক্রান্তের মৃতদেহ নেওয়ার সময় ডেথ সার্টিফিকেট থেকে মৃতের ধর্ম পরিচয় জানা যায়। অহিন্দুর দেহও আমরা সৎকারের ব্যবস্থা করছি। গোরস্থানে পৌঁছে দিচ্ছি মুসলিম, খ্রিস্টানের দেহও।
সমিতির যুগ্ম–সম্পাদক চন্দনবাবু আরও জানালেন, নিমতলা শ্মশানঘাটের ভূতনাথ মন্দিরে সংগৃহীত দানের টাকায় চলে সৎকার সমিতির কাজকর্ম। কিছু মানুষ অর্থ সাহায্যও করেন। রাজ্য সরকারও পাশে আছে তাঁদের। সমিতির হাতে থাকা পাঁচটি শববাহী গাড়ির মধ্যে দু’টি এখন কাজ করছে করোনায় মৃতদের সৎকারের জন্য। এমপি তহবিলের টাকায় একটি গাড়ি দিয়েছেন সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানান, তাদের হাত দিয়ে সৎকার হওয়ার মানুষগুলির আত্মার শান্তি কামনায় মহালয়ার ভোরে গঙ্গাবক্ষে তর্পণ করেন সমিতির সদস্যরা।
করোনা রোগীর দেহ বহনে সমিতির কর্মীরা আপত্তি করেননি? চন্দনবাবু বলেন, ‘না, কারণ আমাদের বিশ্বাস বাবা ভূতনাথ আমাদের বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।' আরও বললেন, 'মৃতদেহের কোনও ধর্ম নেই, তাই অনেক দিনের রীতি ভেঙে এখন অহিন্দুর দেহও গোরস্থানে নিয়ে যাচ্ছে সমিতির শববাহী গাড়ি। এমনই এক অতিমারীর সময়েই তো এই কাজে হাত লাগিয়েছিলেন সমিতির প্রতিষ্ঠাতারা।