শেষ আপডেট: 19th September 2020 11:06
দ্য ওয়াল ব্যুরো: তিনি ছিলেন ভারতীয় বায়ুসেনার বীর সেনানী। ১৯৬২র ভারত চিন যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বীরত্বের সঙ্গে। ঐতিহাসিক সেই যুদ্ধের শরিক হয়ে বেঁচে ফিরেও এসেছিলেন নিজের মাটিতে। চিনা সেনাদের সামনে মাথা ঝোঁকেনি তার। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে শেষপর্যন্ত এক চিনা ভাইরাসের কাছে পরাজিত হলেন আন্দুলের শীতল চন্দ্র মান্না। করোনা সংক্রমিত হয়ে বছর পঁচাশির শীতলবাবু গত ৫ই সেপ্টেম্বর উলুবেড়িয়া ফুলেশ্বরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। বৃহস্পতিবার ১৭ই সেপ্টেম্বর মহালয়ার সন্ধ্যায় মৃত্যু হয় বায়ুসেনা বিভাগের এই প্রাক্তন অফিসারের।
শীতলবাবুর পরিবার সূত্রে জানা যায়, সেপ্টেম্বরের শুরু থেকেই জ্বরে পড়েন শীতল বাবু। স্থানীয় চিকিৎসক দেখানো হলে রোগীর লালারস পরীক্ষার পরামর্শ দেন তিনি। কথা মতো ৩রা সেপ্টেম্বর কলকাতার এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শীতবাবুর লালারস পরীক্ষা করতে পাঠান পরিবারের লোকজন। ৪ঠা সেপ্টেম্বর তাঁর করোনা রিপোর্ট পজিটিভ আসে। দেরি না করে পরের দিনই উলুবেড়িয়া ফুলেশ্বরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় শীতল চন্দ্র মান্নাকে।
তাঁর সময়কার রীতিমতো মেধাবী ছাত্র ছিলেন শীতলবাবু। পড়াশোনা শেষ করে শিবপুর বি ই কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ট্রেনিং নিয়ে মাত্র আঠারো বছর বয়সে দিল্লির বায়ুসেনা দফতরে যোগ দেন তিনি। সম্মানের সঙ্গে টানা ন'বছর চাকরি করার পর স্বেচ্ছা-অবসর নেন সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে। চাকরি জীবনে দেশের অনেক উত্থানপতনেরই সাক্ষী ছিলেন তিনি।
হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে শীতল বাবুর পুত্রবধূ সোনালি মান্না স্মৃতিচারণ করছিলেন সেসব দিনের৷ তিনি বলেন, "শ্বশুরমশাইয়ের কাছ থেকে অনেক গল্প শুনেছি তাঁর চাকরি জীবনের। বায়ু সেনার মেকানিক বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। দেশের সমস্ত যুদ্ধ বিমান তাঁরই তত্ত্বাবধানে থাকত। শুধু তাই নয়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যে বিমানে যাতায়াত করতেন তারও যেকোনও যান্ত্রিক ত্রুটি সংশোধনের দায়িত্ব ছিল শীতলবাবুর। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে ফ্রেমও শেয়ার করেছেন তিনি। সেই ছবি আজও খুব যত্নে সাজানো আছে শ্বশুরমশাইয়ের ঘরে।
তিনি স্মৃতি থেকে তুলে আনলেন বছর দশেক আগে একটি পারিবারিক ভ্রমণের কথাও৷ ভ্রমণসূচি মেনে সেদিন যাওয়া হয়েছিল দিল্লির পালাম এয়ারফোর্স মিউজিয়ামে। সেখানে রাখা একটি বিমানকে দেখে আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিলেন শীতলবাবু। সোনালি দেবীর কথায় "ছেলেমানুষের মতো শ্বশুরমশাই আমার শাশুড়িমাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বললেন, দেখো দেখো এই বিমান আমি দেখভাল করতাম।"
কোভিড আক্রান্তের মৃতদেহ। তাই দাহ করার অধিকার নেই পরিবারের। ১৮ তারিখ শুক্রবার উলুবেড়িয়া ফুলেশ্বরের এক বেসরকারি হাসপাতালে শেষ দেখা করতে গিয়ে তখন শোকে ভেঙে পড়েছেন আন্দুলের মান্না পরিবারের লোকজন। হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়েও নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না শীতল বাবুর স্ত্রী সমিতা মান্না। বললেন, "চাকরি জীবনের কত গল্পই শুনেছি ওঁর মুখে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সফরসঙ্গী হয়েছেন কতবার। ঘুরেছেন একাধিক দেশে। ভারত চীন সমঝোতা চুক্তির কথা বলতেন প্রায়ই। ১৯৬২তে ভারত চিন যুদ্ধের সময় বহু নিরপরাধ ভারতীয় সেনা প্রাণ হারায়। শান্তিচুক্তি সাক্ষরের পরেই মায়ের আদেশে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে স্বেচ্ছা অবসর নেন শীতলবাবু। মায়ের কথাই তাঁর কাছে বেদবাক্য ছিল।" পুরোনো দিনের এসব গল্পের স্মৃতি আঁকড়েই শীতলবাবুকে মনের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে চান তাঁর স্ত্রী সমিতা দেবী।
চোখের জলেই বাবার স্মৃতিচারণ করলেন শীতল বাবুর কন্যা অঞ্জনা পাত্র।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সামনে তিনি দুঃখ করে বলেন, "লকডাউনের আগেই মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে বাবা-মার ৫৪তম বিবাহবার্ষিকীতে কত আনন্দ করলাম পরিবারের সবাই। বাবাও তার নাতি নাতনি ছেলে মেয়ে পুত্রবধূদের নিয়ে কত মজা করলেন। নাতি নাতনিদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর গল্প শোনালেন। শোনালেন নিজের দেশ বিদেশের ভ্রমণ অভিজ্ঞতার গল্পও। সেই আনন্দসন্ধ্যার ছ মাসের মাথায় আজ পিতৃহারা হলাম আমরা। এমনকি তার দেহটুকু স্পর্শ করে কাঁদতেও পারলাম না। "
দেশের শত্রুর সামনেও যিনি ছিলেন কর্তব্যে অটল, করোনা নামক এক অদেখা শত্রুর আক্রমণ আজ তাঁকেই একাকী কেড়ে নিয়ে গেল আত্মীয় বন্ধু পরিজনের মায়ার আবেষ্টন থেকে।