দ্য ওয়াল ব্যুরো: একে লকডাউনের ধাক্কায় বিক্রিবাটা নেই। আগেই কোমড়টা নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল কলেজ স্ট্রিটের ছোট প্রকাশনা ও বই বিক্রেতাদের। তার উপরে একদিনের ঝড় নড়বড়ে কোমরটা যেন ভেঙে দিয়ে চলে গেছে। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে গোটা বইপাড়া। ছোট গুমটি থেকে বড় দোকান সবই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ভেঙেছে গুমটি, বই শুধু ভেজায়নি, ঝড়ের শেষ দেখা গেছে অনেক বই রাস্তায়। জমা জলে ভেসে গেছে অনেক মানুষের ভবিষ্যৎ।
এখন এই মানুষদের পাশে দাঁড়াতে হয়তো সরকারি উদ্যোগ কিছু নেওয়া হবে। ঘুরে দাঁড়ানোর কোনও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ হয়তো মিলবে। কিন্তু তার আগেই নেমে পড়েছেন অনেক বইপ্রেমী, বইপাড়া প্রেমী। অনেকেই অর্থ সংগ্রহ করছেন। শুধু বইপাড়ার ব্যবসায়ীরাই নয়, বই ছাপা, বাঁধাইয়ের সঙ্গে যুক্ত অংসগঠিত ক্ষেত্রের বহু মানুষ। সকলের পাশে দাঁড়াতেই শুরু হয়েছে একাধিক উদ্যোগ।
আরও পড়ুন
এমনই একটি উদ্যোগের নাম 'বই মরে না'। ভিজে বই অনলাইনে বিক্রি করার এই উদ্যোগ যৌথভাবে নিয়েছে 'বোধশব্দ' পত্রিকা ও 'বইঘর ডট ইন' সংস্থা। এই প্রসঙ্গে বোধশব্দ পত্রিকার সম্পাদক সুস্নাত চৌধুরীর দাবি, "অনেকেই অর্থ সংগ্রহ করে সাহায্য করার উদ্যোগ নিয়েছেন। সেটা খুবই দরকার। তার সঙ্গেই আমাদের এই উদ্যোগ। আমরা চাই, প্রকাশক, পুস্তক বিক্রেতাদের জন্য ত্রাণ নয়, বিক্রয়মূল্য। ডোনেশন নয়, প্রাইস। লকডাউন ও সাইক্লোনের জেরে ক্ষতিগ্রস্ত অগুনতি বই ও পত্রিকা। আমরা চাই তার মধ্যে থেকে পছন্দের বইটি স্মারক হিসেবে বেছে নিন বইপ্রেমীরা। এই ভাবেই মানুষ বইপাড়ার প্রকাশক-বিক্রেতাদের পাশে দাঁড়ান। তাই আমরা ভিজে বই অনলাইনে বিক্রি করার পরিকল্পনা করেছি। প্রাথমিক কাজও শুরু হয়ে গেছে।"

নিঃসন্দেহে অভিনব উদ্যোগ। বলছেন ক্রেতারাও। উদ্যোক্তারাই জানালেন, ইতিমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার শুরু হয়েছে। আর তাতে অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এক মহামারীর কালে, এক দুর্যোগের দিনে বইপাড়ার পাশে দাঁড়ানোর স্মারক হিসেবে 'ভিজে' বই কিনে রাখতে চাইছেন অনেকেই।
কীভাবে অনলাইনে ভিজে বই বিক্রি হবে? এই প্রসঙ্গে 'বইঘর ডট ইন'-এর কর্ণধার তুহিন মল্লিক জানান, "অনলাইনে বই বিক্রি করার একটা সেটআপ আমাদের রয়েছে। সেটা সারা বছরের। এবার তার সঙ্গেই সম্পূর্ণ অলাভজনক এই উদ্যোগ। আমরা খুব তাড়াতাড়ি অনলাইনে বইয়ের তালিকা প্রকাশ করব। সেই তালিকায় ক্ষতিগ্রস্ত, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত, এবং ভাল বইয়ের আলাদা আলাদা তালিকা থাকবে। সেখান থেকে পছন্দ করে অর্ডার দিতে হবে। বই পাঠানোর খরচ বাদে বিক্রির পুরো টাকাই তুলে দেওয়া হবে সংশ্লিষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত প্রকাশক ও বিক্রেতার হাতে।" এর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতাদেরও অনুরোধ করা হয়েছে যোগাযোগ করার জন্য।
এই রকমই আরও দু'টি উদ্যোগের কথাও বলতেই হবে। একটি উদ্যোগের নাম, 'বইপাড়ার পাশে'। উদ্যোগ নিয়েছে 'প্রহর ডট ইন' নামে সংস্থা। ইতিমধ্যেই টাকা সংগ্রহ শুরুও হয়ে গিয়েছে। সংস্থার পক্ষে আকাশ গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন, "এখনও অনেক প্রকাশক, বিক্রিতা নিজেরাই জানেন না তাঁদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। লকডাউন না উঠলে, ট্রেন না চললে অনেকেই কলেজ স্ট্রিটে আসতে পারছেন না। আমরা ইতিমধ্যেই তাঁদের সঙ্গে যতটা সম্ভব যোগাযোগ করেছি। বইপাড়াতেও গিয়েছি। আনুমানিক ক্ষয়ক্ষতির একটি খসড়া তৈরি করা হচ্ছে। অন্যদিকে অর্থ সংগ্রহও চলছে। আর তাতে যেমন সাড়া পাচ্ছি তাতে আমাদের মনের শক্তি বাড়ছে। কলেজস্ট্রিট জুড়ে যেসব গুমটি ক্ষতিগ্রস্ত তাদের আর্থিক সাহায্য করব আমরা।"

প্রকাশক, পুস্তক বিক্রেতাদের পাশাপাশি ক্ষতির মুখে বইপাড়ার অসংগঠিত শ্রমিক-কারিগররাও। তাঁদের সাহায্য করার জন্য তৈরি হয়েছে 'বেঁচে উঠুক বইপাড়া' নামে একটি উদ্যোগ। এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত অর্ক দেব জানালেন, "ক্ষতিগ্রস্থ আমুমানিক হাজার দুয়েক অসংগঠিত মানুষ। সমস্যায় পড়া বন্ধুদের জন্য অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যে একটি লেখার সংকলন বা পত্রিকা প্রকাশের কথাও আমরা ভাবছি। তবে এক্ষুণি ওঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাই ত্রাণ সংগ্রহ শুরু করেছি আমরা। বহু মানুষ আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন প্রতিদিন।"

এছাড়াও অনেক উদ্যোগ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। বইপাড়ার মানুষেরাই বলছেন, অনেক ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাহায্য করছেন। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সেটা অনেকটাই কম। আসলে ত্রাণ নয়, বইপাড়া চাইছে আবার ফিরে আসুক আগের সময়। বিক্রি হোক বই। বাঁচুক সবাই। বেঁচে উঠুক বইপাড়ার হইচই।