শেষ আপডেট: 20th January 2025 18:36
রূপক মিশ্র
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। হরিহরের সঙ্গে কুঠির মাঠ ধরে হেঁটে চলেছে অপু। সেই প্রথম গ্রামের বাইরে পা রেখেছে সে। উজ্জ্বল চোখে প্রকৃতির রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ শুষে নিচ্ছে। তখনই ‘প্রাগৈতিহাসিক যুগের অতিকায় হিংস্র জন্তুর কঙ্কালের মতো’ পড়ে থাকা নীলকুঠি এবং একটি সমাধিফলক নজরে আসে তার। যেখানে লেখা: ‘Here lies Edwin Lermor, The only son of John & Mrs Lermor, Born May 13, 1853, Died April 27, 1860.’
কালো সমাধির উপর কালের ছায়া পড়েছে৷ বুনো সোঁদাল গাছ বেড়ে উঠেছে ধার ঘেঁষে। বয়ে আসছে নদীর হাওয়া। খসে পড়ছে শুকনো পাতার দল। চারদিক নির্জন, নিঝুম। শুধু ঝরা পাতার শব্দ আর বাতাসের সুর। নি:সঙ্গতার মুহূর্তটিকে অননুকরণীয় ভঙ্গিমায় ধরে রেখেছিলেন বিভূতিভূষণ: ‘... সকলে ভুলিয়া গেলেও বনের গাছপালা শিশুটিকে এখনও ভোলে নাই।’ একটিমাত্র বাক্য। যেটা পড়ামাত্র পাঠকের মন এক অদ্ভুত বেদনায় দ্রব হয়ে ওঠে।
নীলকুঠির চেনা ‘পথ’, নিশ্চিন্দিপুরের ‘পাঁচালী’ কালের নিয়মে মুছে গেছে। কিন্তু এখনও পথভুলে মেঘডুমরা দিঘির ধারে দু'দণ্ড দাঁড়ালে এক বিষাদঘন পাঁচালীর সুর মনের অতলে আপনা থেকে বেজে ওঠে। দিঘির সামনে একই রকম নীলকুঠির ভগ্নস্তূপ। আর তার এককোণে জীর্ণ, মলিন সমাধি। যেখানে চিরঘুমে শায়িত রয়েছে এক শিশু। পিটার কেরি। উইলিয়াম কেরির পুত্র। স্মৃতিফলকে লেখা: ‘Peter Carey. Son of William and Charlotte Carey. Died October 11th 1796. At the Young Age of 5.’ জনহীন চারপাশ। শুনশান। শুধু সমাধির আশপাশে অতন্দ্র প্রহরীর মতো, বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে বুনো গাছ। খসে পড়ছে পাতা। ভেসে আসছে বাতাসের সুর।
আসলে ‘মেঘডম্বুর’। লোকমুখে ‘মেঘডুমরা’। মদনাবতী গ্রামের একটি পরিচিত ‘ল্যান্ডমার্ক’। মালদহ শহর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছে বামনগোলা ব্লক। বামনগোলার একটি গ্রামের নাম মদনাবতী। রাজ্য সড়কের পাকা রাস্তাকে বাঁ-হাতে রেখে লালমাটির পথ ধরে একটু হেঁটে এলেই পৌঁছনো যায় সেখানে। অখ্যাত গ্রাম মদনাবতীকেই ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে দিয়েছেন উইলিয়াম কেরি। বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট পুরোধা। শ্রীরামপুর কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ। যাঁর তত্ত্বাবধানে রামরাম বসু থেকে চণ্ডীচরণ মুন্সি, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার থেকে তারিণীচরণ মিত্র—সকলে একযোগে বাংলা গদ্যের প্রাথমিক ধাঁচাটি উনিশ শতকের ঊষালগ্নে প্রস্তুত করে ফেলবেন। শ্রীরামপুর প্রেসে ‘বাংলার গুটেনবার্গ’ পঞ্চানন কর্মকার যাঁর বদান্যতা ও আনুকূল্যে বাংলা হরফকে বাইবেল অনুবাদের মাধ্যমে আরও ব্যাপক ও বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে দেবেন।
কেরির জীবনালেখ্য আঁকতে বসলে ফোর্ট উইলিয়াম ও শ্রীরামপুরের কথাই ঘুরেফিরে আসে। উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেয়। বস্তুত, সেই ঔজ্জ্বল্যই মদনাবতীর গৌরবকে অনেকখানি ঢেকে দিয়েছে। সময়ের গতি কিছুটা অন্যরকম হলে মালদহ জেলার এই অখ্যাত গ্রামই হয়ে উঠতে পারত বাংলা সাহিত্যের আঁতুড়ঘর, অন্যতম পীঠস্থান!
সে বিষয়ে আসার আগে অল্প কথায় জেনে নেওয়া যাক কেরির ছেলেবেলা। ১৭৬১ সালে ইংল্যান্ডের নর্দাম্পনসনশায়ারের পলার্সপিউরিতে জন্মগ্রহণ করেন উইলিয়াম কেরি। বাবা এডমন্ড কেরি। পেশায় তাঁতি। ছেলেকেও কাপড় বোনার কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেরির পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে দারিদ্র্যের কথা ভুলে তাকে স্কুল ভর্তি করেন। এই সময় দুরারোগ্য চর্মরোগে আক্রান্ত হন কেরি। স্কুল যাওয়া বন্ধ। উপায় না দেখে ছেলেকের চাষের কাজে লাগিয়ে দেন এডমন্ড।
কিন্তু মাঠের ফসল ফলানোয় চেয়ে নিত্যনতুন ভাষা শেখায় কেরির বেশি আগ্রহ ছিল। এরই টানে অল্পদিনের মধ্যে গ্রিক, হিব্রু, ডাচ, ইতালীয় ভাষা শিখে ফেলেন তিনি। ধর্মেকর্মেও মতি আসে। ব্যাপটিস্ট মতে দীক্ষিত হন। যাজকের নাম জন রাইল্যান্ড৷ এই রাইল্যান্ডের ছত্রচ্ছায়ায় এসে কেরি বুঝতে পারেন, হিংসায় দীর্ণ পৃথিবীতে শান্তি, সৌহার্দ্য ফেরাতে পারে একমাত্র খ্রিস্ট ধর্ম। পৃথিবীর আপামর মানুষকে প্রভু যিশুর পদতলে আনতে পারলে মিলবে মুক্তি, মিলবে মোক্ষ। তার জন্য ধর্মপ্রচারে বেরিয়ে পড়তে হবে৷
এই সময় তাঁর বন্ধুত্ব হয় জাহাজের চিকিৎসক টমাসের সঙ্গে৷ আর রক্তে দোলা তোলে ক্যাপ্টেন কুকের দুর্দান্ত ভ্রমণ কাহিনি। ধর্ম, বন্ধুত্ব আর অ্যাডেভেঞ্চারর নেশা—তিনের টানে ১৭৯৩ সালের ১৩ জুন সাগরে ভেসে পড়েন উইলিয়াম কেরি। ততদিনে বিয়ে হয়েছে। তাই স্ত্রী ডরোথিকেও সঙ্গে নেন তিনি। গন্তব্য ভারতবর্ষ… কলকাতা।
কিন্তু নতুন দেশে তো এমনি এমনি আসা চলে না। তার আগে সেদেশের ভাষা জানতে হবে। তাই পাঁচ মাস সমুদ্রযাত্রায় টমাসের কাছে বাংলা ভাষার অ-আ-ক-খ শিখে নেন কেরি। নতুন ভাষা দ্রুত রপ্ত করার একটা দক্ষতা তো ছেলেবেলা থেকেই ছিল। তাই ১১ নভেম্বর কলকাতা পৌঁছে রামরাম বসুকে মুনশি হিসেবে নিয়োগ করার পর বাংলার রূপ ও রহস্য আরও বিশদে ধরে ফেলতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি তাঁকে।
কলকাতা পৌঁছে কেরির জীবনে অনিশ্চয়তা ও দোলাচল দেখা দেয়। শুধু ধর্মপ্রচার করলে চলবে না। হাতে চাই টাকা। সেই টাকা মিলবে এমন কাজ কই? কে দিতে পারবে মনের মতো কাজের খোঁজ? এরই সন্ধানে কলকাতা থেকে ব্যান্ডেল থেকে নদীয়া থেকে সুন্দরবন ঘুরে কেরি এসে থিতু হন মদনাবতীতে। জর্জ উডনি নামে এক উচ্চপদস্থ অফিসার কেরির দুরবস্থা দেখে তাঁকে মদনাবতী (নামান্তর: মদনাবাটি) নীলকুঠির তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব দেন। মাসমাইনে ২০ টাকা। সুন্দরবন থেকে সুদীর্ঘ নদীপথ অতিক্রম করে গৌড়বঙ্গে উপস্থিত হন উইলিয়াম কেরি (১৭৯৪, ১৫ জুন)। সঙ্গে স্ত্রী ডরোথি ও ছেলে পিটার। এখানে এসে তাঁর জীবন অন্য দিকে মোড় নেয়।
আঠারো শতকের অন্ত্যপর্বে মদনাবতী ছিল ছোট গ্রাম। কয়েক ঘর দরিদ্র কৃষকের বাস। জলহাওয়া স্বাস্থ্যকর নয়। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ লেগেই থাকে। তবু এই প্রতিকূলতার মধ্যেও জীবিকার নিশ্চয়তা পেয়ে কেরি আশ্বস্ত হন। ১১ একর জমি নিয়ে গড়ে উঠেছিল উডনি সাহেবের নীলকুঠি। কুঠিয়াল হিসেবে কাজ যথেষ্ট শ্রমসাধ্য। তবু তার মধ্যে সময় বের করে নিজেকে গ্রামীণ সমাজের অঙ্গনে মেলে ধরেন কেরি। স্থানীয় গ্রামবাসীর নিরক্ষরতায় ব্যথিত হন। তাঁদের সাক্ষর করার প্রেরণায় গড়ে তোলেন বিদ্যালয়। পাশাপাশি খ্রিস্টের বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে আশপাশের গ্রাম ঘুরে বেড়াতে থাকেন। এর জন্য কখনও কখনও দশ ক্রোশ পর্যন্ত হাঁটতে হত তাঁকে। বাঙালি সমাজে জাতিভেদ, কুসংস্কার, সতীদাহ, শিশুহত্যা তখনও যথেষ্ট প্রবল। এসব দেখে কেরি ক্রমশ ক্লিন্ন বোধ করতে শুরু করেন।
যদিও আত্মপ্রস্তুতির জন্য ভাষাশিক্ষা জারি রাখেন তিনি। রামরাম বসু তাঁর সঙ্গে বেশ কিছুদিন মদনাবতীতে ছিলেন। পরে এসে যোগ দেন জন ফাউন্টেন নামে এক মিশনারি যুবক। তাঁদের সাহচর্যে বাংলার গড়ন ও চলন অনেকটাই আত্মস্থ করে ফেলেন উইলিয়াম কেরি। কিন্তু শুধু ভাষার বিজ্ঞানটুকু শিখলেই তো হবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না তা কাজে লাগানো হচ্ছে, ভাষাশিক্ষা অসম্পূর্ণই থাকে।
একথা ভেবে কেরি বাইবেল অনুবাদে লেগে পড়েন। এর ফলে একদিকে প্রচারের কাজ সহজ হবে। পাশাপাশি বাংলা লেখার বিষয়টিও আয়ত্ত করে ফেলবেন তিনি। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে কেরি অনুবাদে নিমগ্ন থাকেন। অক্লান্ত পরিশ্রমে ভগ্নস্বাস্থ্য, তবু কলম থামে না। অবশেষে পাঁচ বছর বাদে অনুবাদ সম্পূর্ণ হয়।
ভাষাশিক্ষা শেষ। অনুবাদও হল। এবার কাজ হাতের লেখাকে মুদ্রণের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া। হয়তো এতকিছুর আগাম একটা পরিকল্পনা ইংল্যান্ডে থাকতেই ছকে ফেলেছিলেন কেরি। নয়তো কেন দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় আস্ত একটি মুদ্রণযন্ত্র সঙ্গে নিয়ে আসবেন তিনি! এবার সেই মেশিনকে কাজে লাগানোর পালা। তাই ধুলো ঝেড়ে মুদ্রণযন্ত্রটি বের করেন। উদ্দেশ্য: বাইবেলের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ। তার জন্য খেটেখুটে টিন কেটে তৈরি করেন বাংলা হরফের ছাপাখানা। জোগাড় করেন কম্পোজার, মেশিন চালক। মনমতো না হলেও তখনকার মতো কাজ চলে চলে যাবে ঠিক।
সবকিছু যখন প্রস্তুত তখনই বাদ সাধে মুদ্রণযন্ত্র। কলকব্জা নাড়াঘাঁটা করতে গিয়ে কেরি বুঝতে পারেন জাহাজে নিয়ে আসার সময় এর যন্ত্রাংশ বিকল হয়ে পড়েছে। ঠিক করা অসম্ভব। হন্যে হয়ে সারাই করার লোক খোঁজেন। কিন্তু কেউ মেলে না। আশাহত হন কেরি। ততদিনে ব্যক্তিগত জীবনেও দুর্যোগ দেখা দিয়েছে। অজানা জ্বরে হারিয়েছেন ছেলে পিটারকে। যার ধাক্কায় স্ত্রী ডরোথিও জটিল মানসিক রোগে আক্রান্ত।
এই সময় জানতে পারেন বিলেত থেকে সোসাইটির উদ্যোগে জশুয়া মার্শম্যান, উইলিয়াম ওয়ার্ড, উইলিয়াম গ্রান্ট সহ একটি মিশনারি দল ভারতে আসছে। ছাড়পত্রের সমস্যা থাকায় কলকাতায় নয়, তাঁরা উঠবেন হুগলির ধারে দিনেমারদের উপনিবেশ শ্রীরামপুরে। একথা শুনে কেরি মদনাবতীর পাট গুটিয়ে ফেলার তোড়জোড় শুরু করেন। ইতিমধ্যে নীলকুঠি বন্ধ হয়ে যেতে পারে—এটা আগাম অনুমান করে মদনাবতীর কাছে খিদিরপুরে একটি সম্পত্তি কিনেছিলেন তিনি। কিন্তু এ অঞ্চলে আর মন বসছিল না তাঁর। তাই বিকল মুদ্রণযন্ত্রটি সঙ্গে নিয়ে স্ত্রী ডরোথির হাত ধরে উইলিয়াম কেরি শ্রীরামপুরের উদ্দেশে রওনা হন। ছেড়ে যান নিজের হাতে গড়ে তোলা স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, দু:স্থ মানুষদের সাহচর্যের স্মৃতি… আর ছেলে পিটারকে। মেঘডম্বুর দিঘির পাশে যাকে সমাধিস্থ করেছিলেন তিনি।
জন লার্মরের সন্তান এডউইনকে ভুলে গেছিল নিশ্চিন্দপুর। মদনাবতী কিন্তু পিটারকে মনে রেখেছে। আজও প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে এই গ্রামে বসে মেলা… ‘কেরি সাহেবের মেলা’। আশপাশের গ্রাম এমনকি দূরের মানুষেরাও তাতে যোগ দেন। উডনি সাহেবের ভগ্ন নীলকুঠি ঘুরে দেখেন সকলে। ঠিক তখনই হয়তো কোনও ছোট্ট অপুর চোখ পড়ে সমাধিতে। আর মেঘডুমরা দিঘির হাওয়ার টানে গায়ে খসে পড়ে শুকনো পাতার দল।