সুকমল শীল
'কলকাতা পুরসভা প্রতিবছরই কমিটি গঠন করে। কাজের কাজ কিছুই হয়না।' বললেন, বিকাশ বেরা। চিত্তরঞ্জন এভিনিউ সংলগ্ন বসাকবাগান লেনের বাসিন্দা। তাঁর কথায়, 'প্রতিবারই জল জমে এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু চলতি মরসুমের নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। আমরা এলাকার ভুক্তভোগীরা বহুবার পুরসভায় গিয়েছি। সুরাহা পাইনি। এখানকার ড্রেনেজ পাইপলাইনের গলদ রয়েছে। আমাদের পরিস্থিতি নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। বর্ষায় একটু বেশি বৃষ্টি হলেই দু'তিনদিন জল জমে থাকে। বাচ্চারা জলে পড়ে যায়। খাওয়ার জল ঘাড়ে করে কিনে আনতে হয়।'

ঠনঠনিয়া, কালাকার স্ট্রিট, মহাত্মা গান্ধী রোড, কলেজ স্ট্রিট, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ। টানা কিছুক্ষণ বৃষ্টি হলে শহরের আর কোথাও জল জমুক আর না জমুক, এসব জায়গায় জল জমবেই। তখন নৌকো ছাড়া কোনও যানই কাজে লাগে না। কিন্তু রাস্তার ওপরে জল, তাই নৌকোর বদলে চাহিদা বেড়ে যায় হাতে টানা রিকশর। বললেন, ঠনঠনিয়ার হাতে টানা রিকশর চালক খুবলাল দাস। বললেন, 'ছোট থেকে দেখছি। বর্ষায় আমাদের কদর বেড়ে যায়। কোমরজলে এই রিকশ ছাড়া কিছুই চলে না। কোমরজল পর্যন্ত টানতে পারি। কিন্তু গলাজলে পারিনা। তবে এবছর বর্ষায় আমি রিকশা নিয়ে বেরোতে পারিনি। বুক পর্যন্ত জল জমেছিল ঠনঠনিয়ায়। এরকমই থাকবে। সরকার কিছুই করবে না।'

বর্ষা নামলে নিকাশির অভাবে জলেই বন্দি হয়ে থাকে এইসব এলাকা। চিত্তরঞ্জন এভিনিউ, ঠনঠনিয়া, কলেজস্ট্রিটের জলযন্ত্রণার এটাই পরিচিত ছবি। পুর পরিষেবা নিয়ে পুরবাসীর অভিযোগের তালিকায় নিকাশির অব্যবস্থা এখনও সবার উপরে। যদিও পুর এলাকার প্রবীণ বাসিন্দাদের দাবি, নিকাশির এ হেন বেহাল চিত্র অতীতে তাঁরা দেখেননি। ইতিহাসের পাতা বেয়ে যদি ইংরেজ আমলেও ফিরে যাওয়া যায় তা হলে কিন্তু নিকাশি নিয়ে বর্তমান অবস্থার উল্টো ছবিটাই ধরা পড়ে এই এলাকায়। অনেক প্রবীণের এমনটাই দাবি।

কলেজস্ট্রিটের বইবিক্রেতা শেখ আখতার আহমেদ জানালেন, জল জমার ফলে সবথেকে ভুক্তভোগী তাঁরা। বললেন, '২৫ বছর যাবৎ দোকানদারি করছি। আগেও কলেজস্ট্রিটে জল জমত। কিন্তু গত দুবছরের মতো জল জমতে কোনওদিন দেখিনি। জল নামাতে পুরসভা সম্পূর্ণ ব্যর্থ! এবছর চারবার দোকানে জল উঠেছে। বহু টাকার বই নষ্ট হয়েছে। বুকসেলার্স গিল্ড-আমরা অনেকে মিলে পুরসভায় গিয়েছিলাম। কিন্তু কোনও সুরাহা পাইনি।'
[caption id="attachment_2407116" align="aligncenter" width="715"]

স্থানীয় বাসিন্দা[/caption]
শুধু তিনি এক নন, বৃষ্টি হলেই ইষ্টনাম জপতে থাকেন এলাকার মানুষজন। এই এলাকার এক প্রবীণ বাসিন্দার কথায়, 'রাজ্যে যে পুরনো পুরসভাগুলি রয়েছে কলকাতা তার অন্যতম। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এখনও নিকাশির মতো প্রতিদিনের গুরুত্বপূর্ণ চাহিদাই পুর কর্তৃপক্ষ মেটাতে পারলেন না।'

৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী তৃণমূল কো-অর্ডিনেটর এবং প্রার্থী সোমা চৌধুরী প্রচারের ব্যস্ততার মধ্যেই বললেন, 'আমার ওয়ার্ডে জল জমার সমস্যাই একমাত্র মাথাব্যাথা। আর কোনও সমস্যা নেই। এটা নিয়ে বহুবার পুরসভায় বলেছি। মেয়র ফিরহাদ হাকিম নিজে এসে দেখে গেছেন। যতটা সম্ভব সুরাহা করার চেষ্টা করছি।'
উত্তর-মধ্য কলকাতার এই চাওয়া-পাওয়ার জটিল অঙ্কেই ফের আর একটা পুর নির্বাচনের দোরগোড়ায় পুর কর্তৃপক্ষ। মানুষের চাহিদা পূরণের শর্তে খুব স্বাভাবিক কারণেই ভোটের অঙ্কও আবর্তিত হবে। যাঁরা এতদিন ক্ষমতায় রয়েছেন তাঁরা এখন মরিয়া, গত পাঁচ বছরে সুষ্ঠু পরিষেবার লক্ষ্যে পুরবাসীর জন্য কী করেছেন তার ফিরিস্তি দিতে। আর গত পাঁচ বছরে পুর কতৃপক্ষের ব্যর্থতা তুলে ধরতে ব্যর্থ বিরোধীরা। এমনটাও মত অনেকের।

কিন্তু ভোটের আগে নিজেদের দাবিদাওয়া, দুঃখ-কষ্ট নিয়ে অনেকেই মুখ খুলেছেন। অনেকে চেপে রাখছেন। ভুক্তভোগী পুরবাসী এখন শেষ পর্যন্ত এই আশ্বাসে কতটা সাড়া দেন, এখন তারই অপেক্ষা।