শেষ আপডেট: 3rd July 2023 16:43
অনেকেই মনে করেন বিশ্বে একমাত্র নীতিবাদী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যদিও ইতিহাস প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র স্বার্থ তার কর্পোরেট বা অর্থনৈতিক স্বার্থ। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বাক্ স্বাধীনতা এই সব কিছুই কথার কথা।
এই সব ইস্যুতেই নরেন্দ্র মোদীকে আমেরিকা একবার ভিসা দিতে অস্বীকার করেছিল। সেই মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি দিল্লির কুর্সি দখল করতেই এক গুচ্ছ ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির হন ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েল। মোদী তখনও সরকার গঠন করেননি। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষে তাঁকে হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রণ জানাতে ভোলেননি পাওয়েল।
কারণ ভারত একটি উঠতি অর্থনীতি। ২০৫০ সাল নাগাদ হয়ে যেতে পারে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরের আগে যুক্তরাষ্ট্রের ৭৫ জন আইন প্রণেতা প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে চিঠি লিখে বলেন, তিনি যেন মোদীকে ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেন। হোয়াইট হাউজের মূখপাত্র কিন্তু সাফ জানিয়ে দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে মানবাধিকার বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়া বাইডেন প্রশাসনের কাজ নয়।
যুক্তরাষ্ট্র কুড়ি বছর আফগানিস্তানে সকল ধরণের সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে এক কাপড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। প্রতিপক্ষ জোব্বা আর পাগড়ি পরা কয়েক হাজার তালেবান। আবার এই তালেবানদের সত্তরের দশকে সৃষ্টি করেছিল আমেরিকা আফগানিস্তান দখলকারি তৎকালিন সোভিয়েত বাহিনীকে মোকাবেলা করতে।
বর্তমান বিশ্বে চিন যে বড় শক্তি তা শুধু অস্ত্রের জোরে নয় বরং ক্রমবর্দ্ধমান অর্থনীতির সুবাদে। যুক্তরাষ্ট্রকে অনেকটা কোণঠাসা করে ফেলেছে দেশটি। আমেরিকার ভুল পররাষ্ট্রনীতির কারণে তাদের অনেক পুরনো পরীক্ষিত মিত্র বর্তমানে চিনকে পরম মিত্র হিসেবে মেনে নিয়েছে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশই এখন আর যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের পরম মিত্র মনে করে না, যতটা করে চিনকে। আফ্রিকা অনেক আগে হাতছাড়া।
বাংলাদেশে এখনও কিছু রাজনৈতিক দল আর এক শ্রেণির সব জান্তা সুশীল ব্যক্তি সর্বদা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংকশন নিয়ে বেশ উৎসাহিত থাকেন। তারা হয়তো জানেন না চিনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কত ধরণের নিষেধাজ্ঞা বলবৎ আছে। অথচ চিন থেকে যুক্তরাষ্ট্র সর্বাধিক পণ্য আমদানি-রপ্তানি করে।
আসি বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফর প্রসঙ্গে। মোদীকে আমেরিকা যখন ভিসা স্যাংকশন দিয়েছিল তখন তিনি ভারতের একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। সেই নরেন্দ্র মোদীকে যুক্তরাষ্ট্র এবারের সফরে আতিথেয়তায় ভরিয়ে দিয়েছে। মোদীকে রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যা অত্যন্ত সম্মানের।
বাংলাদেশের মানুষের দৃষ্টি ছিল মোদী তাদের দেশকে নিয়ে বাইডেনকে কী বলেন সেই দিকে। একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন অন্য দেশে রাষ্ট্রীয় সফরে যান তখন তৃতীয় একটি দেশের বিষয়ে কথা বলবেন তখনই যখন তাদের কর্মকাণ্ডে নিজ দেশের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোন দেশ যখন পাকিস্তানকে আধুনিক সমারাস্ত্র সরবরাহ করে তখন ভারত স্বাভাবিক কারণেই অসন্তুষ্ট হয়। কারণ দেশের জাতীয় নিরাপত্তার চেয়ে অন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ঠিক একই ভাবে যুক্তরাষ্ট্র যদি ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত মিত্র বাংলাদেশের বেলায় কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে যা ভারতের জন্য বড় ধরণের ক্ষতির কারণ হতে পারে তা হলে সে বিষয়ে মোদী মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করতেই পারেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী চাইবেন তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলিতে এমন সরকার থাকুক যা তার জাতীয় নিরাপত্তা বা অন্যান্য স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর না হয়। ভারতের নিজস্ব নিরাপত্তা আর অর্থনৈতিক স্বার্থে একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ প্রয়োজন অনেক বেশি।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলিয় রাজ্যগুলিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সব ধরণের মদত দিত। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বিদেশ থেকে আধুনিক অস্ত্র সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে ব্যবহার করত। ২০০৪ সালে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক তার একটা বড় উদাহরণ আর তার নিয়ন্ত্রক ছিল লন্ডনে পলাতক বেগম জিয়ার পুত্র তারেক রহমান, যে অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তিনি এই সব শুধু বন্ধই করেননি, একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে আটক করে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছেন। বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলিয় রাজ্যগুলিতে পণ্য সরবাহ বদলে দিয়েছে সেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়াটা ছিল দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের একটি মাইল ফলক।
অন্যদিকে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া অসুস্থ এবং দুর্নীতির অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত আসামী। বিএনপির প্রধানমন্ত্রী মুখ তারেক রহমান দীর্ঘ মেয়াদি সাজা মাথায় নিয়ে লন্ডনে পলাতক। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জেমস মোরিয়ার্টি স্টেট ডিপার্টমেন্টকে লিখেছিলেন, ‘তারেক রহমান একজন বিপজ্জনক ব্যক্তি। তাঁকে যেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ভিসা দেওয়া না হয়’। প্রকাশ্যে ঘোষণা করে কোন বাংলাদেশিকে ভিসা বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা এই প্রথম। সেই তারেক রহমানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তনের কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি।
সব শেষে বলি ইতিহাস বলছে যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের কর্পোরেট স্বার্থে অন্য দেশের বারোটা বাজাতে চায় তারা শুরু করে মানবাধিকার দিয়ে। তারপর আসে গণতন্ত্র আর গণতন্ত্র মেরামত করতে তাদের হয়ে তখন ভাড়াটে হিসেবে কাজ করে তৃতীয় শক্তি। প্রয়োজন পড়লে এর পর রপ্তানি করে অশান্তি। ভাড়ায় খাটায় জন্য শক্তি এখন বাংলাদেশে সহজ লভ্য। অতএব সাধু সাবধান।
মতামত ব্যক্তিগত
লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান।