শেষ আপডেট: 15th June 2023 06:44
দ্য ওয়াল ব্যুরো: “তিন-মুখো তিন রাস্তা গেছে তারি একটা ধ'রে/চলবে সিধে নাক বরাবর, ডান দিকে চোখ রেখে/ চলতে চলতে দেখবে শেষে রাস্তা গেছে বেঁকে. দেখবে সেথায় ডাইনে বায়ে পথ গিয়াছে কত/তারি ভিতর ঘুরবে খানিক গোলকধাঁধাঁর মত”...
সুকুমার রায় এইভাবেই পথ নির্দেশ দিয়েছিলেন একটি কবিতায়। এখন তো জিপিএসই সেই কাজ করে দেয়। আর জিপিএসের সাহায্য ছাড়া মানুষই গোলকধাঁধাঁয় ঘুরতে পারে, কিন্তু পরিযায়ী পাখিরা (Migratory Birds) নৈব নৈব চ। হাজার হাজার মাইল রাস্তা তাদের নখদর্পনে। জঙ্গল, পাহাড়, নদী, সমুদ্র যে পথই দেওয়া হোক না কেন, ডাইনে-বাঁয়ে ঘুরে, আকাশের পথে বাঁক নিয়ে ঠিক পৌঁছে যাবে ঠিকানায়।
মেঘ পিয়ন বার্তা পৌঁছয় তাদের। শীত পড়ার শুরুতে বা শীত আসার আগেই সুদূরের টানে ঘর ছাড়ে তারা। হাজার হাজার মাইল রাস্তা চিনে উড়ে আসে। বিদেশি অতিথি পরিযায়ীরা (Migratory Birds) খুব নিয়মনিষ্ঠ। সময়ের কাঁটা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে তারা। দিশা চিনতে এতটুকু ভুল হয় না। জঙ্গল, পাহাড়, নদী, সমুদ্র পেরিয়ে একেবারে ভৌগোলিক অবস্থান মেনে সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে যায় সঠিক সময়ে। কীভাবে এত দূরের রাস্তা চিনতে পারে পাখিরা সেটাই রহস্য। আর সেই রহস্য বের করতেই বছরের পর বছর গবেষণা করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা।
তাদের কাছে তো কম্পাস নেই, ম্যাপও নেই। মানুষের মতো কম্পিউটারও নেই। তাহলে? কানাডার ওয়েস্টার্ন ওন্টারিও ইউনিভার্সিটি ও বাওলিং গ্রিন স্টেট ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, পরিযায়ী পাখিদের ব্রেনই হল কম্পিউটার। এর মধ্যেই রয়েছে রক্ত-মাংসের জিপিএস। এই সিস্টেম এতটাই শক্তিশালী যে মানুষের তৈরি কম্পাসকেও হার মানাতে পারে। এই জিপিএস পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র বুঝতে পারে। তার টানেই রাস্তা চিনে নেয় তারা।
পিঁপড়েও দুধ দেয়? থকথকে ঘন ভিটামিনে টইটম্বুর, আশ্চর্য খোঁজ বিজ্ঞানীদের
ইউরোপিয়ান জার্নাল অব নিউরোসায়েন্সে পরিযায়ী পাখিদের ব্রেনের রহস্য নিয়ে গবেষণামূলক প্রতিবেদন ছেপেছেন বিজ্ঞানীরা। সেখানে তাঁরা দাবি করেছেন, পরিযায়ী পাখিদের দেহে এক ধরনের প্রোটিনের খোঁজ পাওয়া গেছে, যা আকাশে তাদের সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় চুম্বকের মতো কাজ করে। দিক ভুল হতে দেয় না। আর সেই চুম্বককে টেনে রাখে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র।
পৃথিবীর চুম্বকের টানে সক্রিয় হয় ব্রেনের জিপিএস, প্রোটিনের সুইচ জ্বালিয়ে রাস্তা চিনে নেয় তারা
ঠিক কবে পাখিরা নিজেদের জায়গা ছেড়ে দূর দূর দেশে পাড়ি দেওয়া শুরু করল, তা জানা যায় না। তবে ৩,০০০ বছর আগে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল আর হোমার পরিযায়ী পাখি দেখেছিলেন। প্রতি বছরই এরা আসে। ভারতে পরিযায়ী পাখিরা আসে হিমালয়ের ওপারে চিন, মঙ্গোলিয়া বা রাশিয়া থেকে। আবার কিছু পাখি হিমালয়ের ওপর থেকেই নীচে সমতলে নেমে আসে। এদের অলটিটিউড-ল্যান্ড মাইগ্রেন্ট বলে। কিছু পাখি আছে লোকাল মাইগ্রেন্ট। যারা অন্যান্য সময় শ্রীলঙ্কা, ভুটান সহ বিভিন্ন ভারতীয় উপমহাদেশে ঘুরে বেড়ায়। এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া শুধুই খাবার আর আশ্রয়ের জন্য।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, আকাশে হাজার হাজার মাইল ওড়ার সময় পরিযায়ী পাখিদের দেহে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের জন্য এক ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়। তাতে ক্রিপটোক্রোমস প্রোটিন (cryptochromes) তৈরি হয়। এই প্রোটিনই পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের কম্পাসের সঙ্গে তাল-মিল রেখে দিশা ঠিক করে। এই প্রোটিনের সুইচ অন ও অফ করতে পারে পাখিরা। প্রোটিনের সুইচ জ্বললেই সরাসরি পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয়। সিগন্যাল আসে পাখিদের ব্রেনে। সক্রিয় হয় জিপিএস। এই গোটা সার্কিটটাই চোখের সামনে যেন ম্যাপ খুলে দেয়। ঠিকানায় বিন্দুমাত্র ভুল থাকে না। আবার ফেরার পথও একই সঙ্গে মাথায় ছকে নেয় পাখিরা।
পরিযায়ীদের এই যাতায়াত বড়ই আশ্চর্যের। এদের কেউ কেউ হাজার হাজার কিলোমিটার পথ একটানা পাড়ি দেয়। আলাস্কা থেকে নিউজিল্যান্ডের যায় বার টেইলড গডউইটস নামের একটি পাখি। এটি একটানা ১১,০০০ কিলোমিটারের বেশি পথ ওড়ে। আবার বার হেডেড গুস (এক রকমের রাজহাঁস) হিমালয়ের ২৯,০০০ ফুট উপর দিয়ে উড়ে আসে। সামুদ্রিক পাখি জলের উপর খুব নীচ দিয়ে ওড়ে। ডাঙায় এলেই উঁচুতে উঠে যায়।
পরিযায়ীদের কোনও কোনও প্রজাতি দল বেঁধে চলে। আবার কেউ একা একা পথ চলাই পছন্দ করে। শুধু শীতেই নয়, বেশ কিছু পাখি অন্যান্য ঋতুতেও আসে। যেমন, চাতক। আফ্রিকা ও ভারতের দক্ষিণ দিক এরা আসে বর্ষাকালে। ছাতারে পাখির বাসায় ডিম পাড়ে। আবার গরম কালে কলকাতার আশেপাশে দেখা যায় প্যারাডাইস ফ্লাই ক্যাচার।
তবে এখন জলবায়ু বদলের ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়েছে পরিযায়ীদের উপরেও। মোবাইল টাওয়ারের তরঙ্গ তাদের সিগন্যালে বাধা তৈরি করছে। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের টান বুঝতেই পারছে না পরিযায়ীরা। রেডিও তরঙ্গ ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে সমস্ত যোগাযোগ। তাই পরিযায়ীদের আসা কমেছে। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের অনেক প্রজাতিও।