শেষ আপডেট: 31st January 2025 18:38
অভিজিৎ মান্না, কাঁথি
বট অশ্বত্থের শিকড়ে জড়ানো বাড়িটা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে কাঁথি শহরের মাঝখানে। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতিবিজড়িত এই নিমক মহলের খোঁজ আর কজন রাখেন। সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে ব্রিটিশ আমলের দু'টি বড় আকারের কামানও।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে তৈরি রাজ্যের একমাত্র লবণ কুঠি হিসেবে এই বাড়ির পরিচিতি। বাংলার বিভিন্ন এলাকায় নীল চাষের জন্যে নীল কুঠি তৈরি করে যেমন ইংরেজরা নীলের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতো তেমনি লবণ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্যে লবণ কুঠি বা নিমক মহল তৈরি করেছিল ইংরেজরা।
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র কাঁথির মহকুমা শাসকের দায়িত্ব নেওয়ার পর এই নিমকমহলে তৈরি হয় মহকুমা শাসকের দফতর। তিনি তিনতলায় বসবাস করতেন বলে জানা গিয়েছে। প্রাচীন এই নিমক মহলের সামনে থাকা দুটি কামান মোগল আমলে হিজলি যুদ্ধের স্মৃতি আঁকড়ে আজও ঝোপঝাড়ের মধ্যে অবহেলায় পড়ে রয়েছে। স্থানীয় মানুষজন প্রাচীন এই নিমক মহলকে হেরিটেজ ঘোষণা করে সংরক্ষণের দাবি তুলেছেন।
কাঁথির মহকুমা শাসকের অফিস চত্বরের এক পাশে ট্রেজারি অফিসের সামনে ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিমক মহল। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার দেওয়ানি লাভ করে। অবিভক্ত কাঁথি মহকুমার ইতিহাস ও যোগেশ চন্দ্র বসুর লেখা মেদিনীপুরের ইতিহাস বই থেকে জানা যায় সেই সময় কাঁথি ছিল হিজলি জেলার অন্তর্গত। মোগল আমল থেকে কাঁথি উপকূল এলাকা লবণ উৎপাদনের জন্যে বিখ্যাত ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লবণ ব্যবসা শুরুর পর ১৭৮০ সালে তৎকালীন হিজলি(কাঁথি) জেলা ও তমলুককে নিমক মহল হিসেবে ঘোষণা করে লবণ ব্যবসা শুরু করে।
১৭৮১ সালে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি সল্ট ডিপার্টমেন্ট নামে একটি আলাদা দফতর তৈরি করে। ১৭৮৭ খ্রীষ্টাব্দে কালেক্টরের পদ তুলে দিয়ে সল্ট এজেন্ট নিয়োগ করে। এই সল্ট এজেন্ট লবণ ব্যবসার পাশাপাশি রাজস্ব সংক্রান্ত কাজকর্মও দেখাশোনা করতেন। ১৭৯৫ সালে সল্ট এজেন্ট কাঁথিতে অফিস, গোডাউন, বাসস্থান নির্মাণ করেন। সেই সময় কাঁথি ছিল জঙ্গল ও বালিয়াড়িতে ভর্তি। বালিয়াড়ির ওপর তৈরি সল্ট এজেন্টের সেই বাড়ি নিমক কুঠি বা নিমকমহল নামে পরিচিত।
প্রায় ২০০বছর আগে বালিয়াড়ির ওপর তৈরি সল্ট এজেন্টের তিনতলা সুন্দর অট্টালিকা এখন ভগ্নপ্রায়। তবু তার গঠনশৈলীর দিক থেকে আজও নজরকাড়া। ১৮৬৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লবণ ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার পর নেগুয়া থেকে মহকুমাশাসকের অফিস স্থানান্তরিত করে এই নিমক মহলে আনা হয়।
১৯৬০ সালে বঙ্কিমচন্দ্র কাঁথির এসডিওর দায়িত্ব নেওয়ার পর নেগুয়াতে থাকতেন। তবে অফিস স্থানান্তরের পর কাঁথির নতুন এসডিও অফিস নিমক মহলের তিনতলায় থাকতেন ও দোতলায় ছিল তৎকালীল এসডিও অফিস। এরপর ১৯৪২ এর ঝড়ে নিমক মহলের তিনতলার অংশ ভেঙে পড়ে। দোতলায় মহকুমা শাসকের দফতর ছিল অনেক দিন। সেই সময় বাড়ির ভিত শক্তপোক্ত করার জন্যে মাটি ফেলা হয় বাড়ির গায়ে। এখন দুর থেকে দেখলে তিনতলা এই বাড়িকে একতলা বলে মনে হয়।
প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ও গবেষক অমলেশ মিশ্র বলেন প্রশাসন ইতিহাস নিয়ে উদাসীন। এই নিমক মহল বা নিমক কুঠির সঙ্গে কাঁথির ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। অবিলম্বে তা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন।
খেজুরি ইতিহাস সংরক্ষণ পর্ষদের কর্মকর্তা অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক সুমন নারায়ণ বাখরা বলেন, "আমরা বারবার খেজুরি ও কাঁথি এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঐতিহাসিক স্থান ও বাড়ির সংরক্ষণের দাবি বারবার জানিয়ে আসছি। কিন্তু কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।"
কাঁথি মহকুমা শাসক সৌভিক ভট্টাচার্য বলেন, "হেরিটেজ কমিশন কিংবা সরকারি স্তরে নিমকমহল সংরক্ষণের কোনও খবর আমার জানা নেই। তবে আমরা নিমক মহল সংরক্ষণ ও চারপাশের এলাকাকে সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করছি। প্রয়োজনীয় অনুমতির জন্যে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।"