শেষ আপডেট: 27th March 2025 11:05
লন্ডনের বাণিজ্য বৈঠকের মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee London) তখন তাঁর বক্তৃতা প্রায় শেষ করে এনেছেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "আমি বিশ্বাস করি আমাদের তৃতীয় চোখ রয়েছে। আমরা আপাতদর্শনে দুটো চোখই দেখতে পাই। কিন্তু এই তৃতীয় চোখটি রয়েছে। এটাই দূরদৃষ্টি। এটাই উদ্ভাবনের চোখ। এটা ছাড়া আমরা এগোতেই পারব না।”
মুখ্যমন্ত্রী যেমন সহজ করে বোঝানোর চেষ্টা করেন, লন্ডনেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। তিনি বলেন, “আমি তো ছবি আঁকা শিখিনি। এখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছবি আঁকতে পারি। এটাই তো উদ্ভাবন।”
তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেন, বাংলায় লগ্নি ও বিনিয়োগের সকল উপাদান রয়েছে। শুধু একটু উদ্যোগ প্রয়োজন। আর প্রয়োজন দূরদৃষ্টি ও উদ্ভাবনের। তাহলেই সোনা ফলতে পারে। তাই একসঙ্গে পথ হাঁটা যাক। তাঁর কথায়, “লেট আস ক্রিয়েট উইন উইন আউটকাম টুগেদার।”
মুখ্যমন্ত্রী এদিন আগেই বলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের (West Bengal) ডেমোগ্রাফি তথা ১১ কোটির জনসংখ্যার কথা। তিনি বলেন, এখানকার দক্ষ শ্রমিকদের প্রতুলতার কথা। বলেন মেধা উৎকর্ষ ও শিল্পবান্ধব পরিস্থিতির কথা। মমতা মনে করিয়ে দেন, ২০০ বছর ভারতে রাজত্ব করার সুবাদে লন্ডন অনেকটাই চেনে বাংলাকে। সংস্কৃতি চেনে, ইতিহাস জানে। তাই লন্ডনের তরফে পশ্চিমবঙ্গে এসে কাজ করা অনেকটাই সহজ হবে।
এই কথার সমর্থনে, এদিনের মঞ্চে শিল্পপতি হর্ষ নেওটিয়াও মুখ্যমন্ত্রীর শিল্পবান্ধব মানসিকতার সপক্ষে তিনটি বিষয় উল্লেখ করেন। প্রথমত, মুখ্যমন্ত্রীর তীব্র ইনক্লুসিভনেস অর্থাৎ সমাবেশী মনোভাব, যা সবাইকে নিয়ে চলার বার্তা দেয়, শান্তি ও সম্প্রীতির কথা বলে। দ্বিতীয়ত, মুখ্যমন্ত্রীর জমানায় যে বিপুল পরিকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, তা পরিস্থিতিকে অনুকূল করেছে। তৃতীয়ত, সমাজের দুর্বল অংশের প্রতি তাঁর আলাদা নজর। যার ফলে সমাজে ক্ষোভ বা অশান্তি অনেক কম। যা শিল্প সহায়ক।
মঙ্গলবার লন্ডনে যে বৈঠক সেরেছেন মুখ্যমন্ত্রী, তার উদ্যোক্তা ছিল ইউকে ইন্ডিয়া বিজনেস কাউন্সিল, ফিকি এবং পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগম। স্থানীয় সময় দুপুর ২টোয় (ভারতীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়) সেন্ট জেমস কোর্ট হোটেলে ১ নম্বর এডওয়ার্ডিয়ান হলে বসেছিল এই বৈঠক। বাকিংহাম প্যালেসের থেকে খানিকটা দূরে এই হোটেলেই থাকছেন মমতা।
এদিন বৈঠকের শুরুটাই হয় সোমবার ভারতীয় দূতাবাসে আলোচনা যেখানে শেষ করেছিলেন, সেখান থেকে। বিষয় লন্ডন-কলকাতা সরাসরি বিমান। ২০১১ সালের আগেই যা বন্ধ হয়ে যায় তা ফের চালু করার জন্য ব্রিটিশ এয়ারওয়েজকে আর্জি করলেন মমতা। তার পরপরই বাংলার রেখা মানচিত্র এঁকে ফেলে বুঝিয়ে দিলেন কেন ব্রিটেন বাংলাকেই বিনিয়োগের জন্য বেছে নেবেন! বললেন বাংলা এমনই, যেখানে কোনও রকম চিন্তা নেই, ক্লান্তি নেই। যেখানে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ৬.৩৭ শতাংশ, বাংলায় সেটাই ৬.৮০ শতাংশে। যাবতীয় জায়গায় যখন বেকারত্বের জ্বালা বাড়ছে, সেখানে বাংলাই ৪৬ শতাংশ কমিয়ে আনতে পেরেছে।
এক এক করে পরিসংখ্যান দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "বাংলায় ৯৪টি সামাজিক প্রকল্প রয়েছে। বিপিএল বা দারিদ্রসীমার নীচে ছিল ৫৭ শতাংশ মানুষ। এখন তা কমে ৮ শতাংশ হয়েছে। বেকারত্বের যে কথা বলছিলাম তার রেশ টেনে বললেন বলতে হবে দেউচা পাচামির কথা। যা বাংলায় সবচেয়ে বড় কয়লা খনি। দেউচার কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। কাজ শেষ হলে আগামী ১০০ বছর বিদ্যুৎ নিয়ে কোনও চিন্তা থাকবে না। বাংলায় আগে খুব কারেন্ট চলে যেত। এখন সেই ঘাটতি মিটেছে। বরং দেউচা হলে বিদ্যুতের দাম আরও কমে যাবে।
অতীতের বাম সরকারের কথা তুলে মমতা আরও বলেন, ম্যানুফ্যাকচার এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আমরা এগিয়ে থেকেও পরে গরিমা হারাই। যা আমাদের সরকার আবার ফিরিয়ে এনেছে। আবার আমরা শীর্ষে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে আমরা শীর্ষে। একাধিক ইন্ডাস্ট্রি পার্ক, মহিলা ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও বাংলা প্রাধান্য দেয়।
এদিন মমতার বক্তৃতায় উঠে আসে মহিলাদের ক্ষমতায়নের খতিয়ানও। তাঁর কথায়, "মহিলা ক্ষমতায়নে দেশে আমরা এক নম্বরে রয়েছি। অন্যেরা মুখে ৩৩ শতাংশ মহিলা সংরক্ষিত জনপ্রতিনিধির কথা বললেও আমার দলে ৩৯ শতাংশ নির্বাচিত সাংসদ মহিলা। নিজে আমি সাত বারের সাংসদ, তিন বারের বিধায়ক। ২০০৪ সালে বিরোধীদের থেকে যখন কেউ জিততে পারেনি, তখনও আমিই জিতেছিলাম। একমাত্র আমি।"
মোদ্দা কথা আজকের বৈঠকে বাংলার যে সাফল্যের পরিসংখ্যান মুখ্যমন্ত্রী তুলে ধরেছেন, তাতে তাঁর শেষ করা কথাগুলো ওয়াকিবহাল মহলের অনেকেই প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছেন। কী সেই কথা? "আমরা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতো লড়াই করতে পারি।"