শেষ আপডেট: 29th October 2024 19:25
এ বছর কালীপুজোয় একেবারে অন্যরকম মা কালীর দর্শন পেতে চান? তাহলে আপনাদের গন্তব্যস্থল হতে পারে বাঁকুড়ার সোনামুখী। এই পৌরশহরে অগুন্তি কালীপুজো হয়, প্রতিটি কালীপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেবীর মাহাত্ম্য। এখানে কালীপুজো চলে টানা পাঁচ দিন। শতাধিক বছরের পুরনো একাধিক পুজো রয়েছে এখানকার অলিগলিতে। তাই সোনামুখীকে কালীক্ষেত্র বললে খুব ভুল হবে না। সদ্য ঘুরে এলাম সোনামুখী থেকে। দেখে এলাম সেখানকার একাধিক জাগ্রত কালী মন্দির। সেসব কালী মাহাত্ম্যই শোনাব এই দীপান্বিতা বেলায়।
লালমাটির পৌর-শহর সোনামুখী ।একদিকে গভীর শাল পিয়ালের জঙ্গল, হাতির আনাগোনা, অন্যদিকে একের পর এক মন্দির। প্রত্যেকটির ঐতিহাসিক মাহাত্ম্য রয়েছে।এই অঞ্চলের স্বর্ণমুখী দেবীর মন্দির থেকে এলাকার নামকরণ হয় সোনামুখী। কুসুমকুমারী দেবী ও হরনাথ ঠাকুর এর জন্মস্থান হিসেবেও সোনামুখী বিখ্যাত। দেবী স্বর্ণমুখীকে সতীর এক অংশ রূপে ধরা হয়। চতুর্ভুজা দেবী, ঘোটক পৃষ্ঠে আরূঢ়া। শুধু কালী পুজো নয় ,এখানে সাড়ম্বরে কার্তিক পুজোও হয় ।
তবে সোনামুখীর কালী বলতে প্রথমেই যাঁর কথা আসে তিনি 'মা-ই-ত মা'। কেন এমন অদ্ভুত নাম কালীর? কেনই বা সোনামুখী নামের প্রাচীন জনপদটি কালীর শহর হয়ে উঠল?
খোকা ঘুমলো পাড়া জুড়লো
বর্গীএলো দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেবো কীসে?'
অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে র্বাংলার বুকে বর্গীরা হানা দিয়েছিল। কিন্তু 'বর্গী' কারা? শব্দটা এলো কোথা থেকে ? মারাঠি শব্দ 'বার্গির' থেকে এর উৎপত্তি ,যার অর্থ দ্রুতবেগে গতিশীল অশ্বারোহীর দল। সাত হাত লম্বা কম্বল ও বর্শা নিয়ে দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে ছুটে আসত বর্গীরা। সোনামুখীও বর্গী হানায় আক্রান্ত হয়েছিল। সেই সময়ে সোনামুখীতে আসেন মারাঠা সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিত। মারাঠা সেনাপতি সদলবলে বিষ্ণুপুর থেকে সরাসরি সোনামুখীতে পৌঁছেছেন । এই খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন সোনামুখীর মানুষ ভয়ে তটস্থ হয়ে পড়েন । দরজা-জানালা বন্ধ করে এক প্রকার গৃহবন্দী হয়ে পড়েন সোনামুখীবাসী।
বর্গীদের আসার খবরে যখন ভয়ে কাঁপছে গোটা সোনামুখী তখন নিঝুম সন্ধেয় জঙ্গলাকীর্ণ পথে ভাস্কর পণ্ডিত দেখতে পান এক বৃদ্ধকে। হাড়িকাঠের সামনে পুজো করছিলেন বৃদ্ধ। লোকশ্রুতি, সেই বৃদ্ধকে মারতে খড়্গ তুলে ধরেন ভাস্কর পণ্ডিত। সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিশক্তি হারান ভাস্কর ।তাঁর মনে হতে লাগে উদ্যত খড়্গ যেন পিছন থেকে কেউ টানছে । ভাস্কর পণ্ডিত সেই সময় অত্যন্ত রাগত স্বরে বলেন, "কে আমার খড়্গ টেনে ধরেছিস?" বর্গীর দল উত্তর দিল, "না পিছন থেকে খড়্গ তো কেউ টেনে নেই" । তবু খাঁড়া বৃদ্ধের দিকে এগোয় না। দৃষ্টিহীন ভাস্কর ছটফট করতে থাকেন।
এরপর ওই বৃদ্ধকে মন্দিরের ঘটের জল ছিটিয়ে ভাস্কর পণ্ডিতের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনেন। অনুতপ্ত ভাস্কর পণ্ডিত বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করেন "এখানে কি কোনও দেবতা আছেন?" বৃদ্ধ উত্তর দেন, "হ্যাঁ, পর্ণকুটিরে মা কালী আছেন ।" তখন ভাস্কর পণ্ডিত চিৎকার করে ওঠেন ‘মা-ই-তো কালী’। সেই থেকেই এই কালী প্রতিমার নাম হয়ে যায় ‘মা-ই-তো কালী ‘। মারাঠী ভাস্কর পণ্ডিতের অবাঙালি উচ্চারণেই হয়ে যায় কালীর নাম। ভাস্কর নাকি খড়্গ রেখে যান মায়ের চরণে। ধীরেধীরে পর্ণকুটির রূপ নেয় মন্দিরের । বিশাল কাঠামোর উপর মাটি দিয়ে প্রতি কালীপুজোয় তৈরি হয় বিশালাকার কালী মূর্তি।