শেষ আপডেট: 23rd December 2024 12:53
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বিদায়লগ্নে দাঁড়িয়ে আছে ২০২৪। কত ঘটনার সমাহার আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি লেপ্টে রইল গোটা বছরটার গায়ে। কতকটায় মন ভাল, আবার কতকটায় মন খারাপ। এই যেমন কত গুণীজনের চিরবিদায়ের শোকগাথা রচিত হল এই একটা বছরে। মৃ্ত্যু শাশ্বত। তবুও তারই মধ্যে নানা সৃষ্টি ও কর্মকাণ্ডে সমাজকে ঋদ্ধ করা এই ব্যক্তিরা কাল জয় করেই হয়তো আজীবন থেকে যাবেন মানুষের মনে।
বাংলায় বামপন্থার উত্থানলগ্নে মুজাফ্ফর আহমেদ, প্রমোদ দাশগুপ্তের মতো নেতাদের কাছ থেকে রাজনীতির পাঠ নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক হওয়ার পর রাজনীতির ময়দানেই জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বিধায়ক হয়েছেন। হয়েছেন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী ও পুলিশমন্ত্রী। জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রীত্ব ছাড়ার পর ২০০০ সাল থেকে ২০১১ সাল, এই ১১ বছর বুদ্ধবাবুই সামলেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব।
২০১১ সালে বিধানসভায় হারের পরেই রাজনীতি থেকে ক্রমশ নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। শরীরও অসুস্থ হয়ে পড়ছিল বারবার। যার জেরে দলের পলিটব্যুরো থেকে অব্যহতি নেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত পাম অ্যাভিনিউর দু-কামরার ফ্ল্যাটেই কেটেছে দিন। আগাগোড়াই বুদ্ধদেববাবু ছিলেন একজন আদ্যন্ত সাহিত্য অনুরাগী। কাকা সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো তাঁর জীবনেও ছিল রবীন্দ্রনাথের গভীর প্রভাব। ফ্যাসিবাদ নিয়ে তাঁর গবেষণা ও লেখা বাংলা ভাষার চিরকালীন সম্পদ। ৮ অগস্ট বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা ২০ মিনিটে কলকাতার পাম অ্যাভিনিউর বাড়িতে মৃত্যু হয় তাঁর।
বাঞ্চারামের বাগান ফেলে রেখে ১২ নভেম্বর তারার দেশে চলে গেলেন প্রবাদ প্রতীম নাট্যকার, লেখক ও অভিনেতা মনোজ মিত্র। সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত মনোজ মিত্রের বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। সল্টলেকের ক্যালকাটা হার্ট ইন্সটিউটে ভর্তি ছিলেন থিয়েটার, টেলিভিশন, সিনেমা জগতের এই দাপুটে শিল্পী। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
১৯৩৮ সালের ২২ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা জেলার ধূলিহর গ্রামে মনোজ মিত্রের জন্ম। ১৯৫৮ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে অনার্স-সহ স্নাতক হন তিনি। এই কলেজে পড়ার সময়েই থিয়েটারে হাতেখড়ি। ১৯৫৭ সালে মঞ্চে প্রথম আত্মপ্রকাশ মনোজ মিত্রর। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন। তার আগে বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেন।
এবছরই প্রয়াত হলেন বৌদ্ধচর্চার বিশিষ্ট পণ্ডিত সুনীতিকুমার পাঠক। বয়স হয়েছিল ১০১ বছর। বার্ধক্যেও থেমে ছিল না তাঁর জ্ঞানচর্চা।
রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীতে সুনীতিকুমারের উদ্যোগেই ১৯৫৪ সালে শুরু হয়েছিল ভারত-তিব্বতী চর্চা। সেই থেকে শান্তিনিকেতনেই ছিল তাঁর বাস। ১৯২৪ সালের ১ মে পশ্চিম মেদিনীপুরের মলিঘাট গ্রামে জন্মেছিলেন সুনীতিকুমার। ছোটবেলায় মাকে হারানোর পর বড় হয়েছিলেন মামাবাড়িতে। সংস্কৃত কলেজের ছাত্র ছিলেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। জীবনের পরবর্তী তিব্বতী ভাষাশিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৫৪ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পুঁথি বিভাগে যোগদান করেন সুনীতিকুমার পাঠক। সেখানেই কাটে তাঁর কর্মজীবন। শান্তিনিকেতনের অবনপল্লীতেই নিভল তাঁর জীবনদীপ।
ছোটবেলা থেকেই থিয়েটার আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন উমা। তাঁর স্কুলের প্রধানশিক্ষকের সঙ্গে সখ্য ছিল সত্যজিৎ রায়ের। সেই শিক্ষকের সাহায্যেই দুর্গাকে খুঁজে পান সত্যজিৎ। পরিবার প্রথমে রাজি না হলেও, পরিচালকই অনুমতি আদায় করে নেন। তারপরের ঘটনাতো ইতিহাস। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী রচনা 'পথের পাঁচালী'কে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন কিংবদন্তি পরিচালক সত্যজিৎ রায়। সেই সিনেমায় 'দুর্গা'র ভূমিকায় তাঁর অভিনয় মন ছুঁয়েছে আম বাঙালির। 'পথের পাঁচালীর' পরেও বেশ কিছু ছবিতে কাজ করেন অভিনেত্রী। কিন্তু বাঙালির কাছে উমা দাশগুপ্ত আদরের দুর্গা হয়েই রয়ে গিয়েছেন। লাইমলাইট থেকে নিজেকে দূরে রাখতেই পছন্দ করতেন বরাবর ৷ জীবিকা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতাকে। যাদবপুর বিদ্যাপীঠে বাংলা পড়াতেন তিনি। ক্যানসারে ভুগছিলেন বেশ কিছুদিন ধরেই। ১৮ নভেম্বর সকালে পথের পাঁচালির স্মৃতি নিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন তিনি।
'ময়নাতদন্ত', 'চোখ', 'দেবশিশু'-র মতো ছবি করে বাঙালির মন ছুঁয়েছিলেন তিনি। ১৯৮২ সালে 'চোখ' ছবিটি সেরা চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় পুরস্কার জিতেছিল। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার থেকে এনএফডিসি-র স্বর্ণপদক পর্যন্ত পেয়েছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক উৎপলেন্দু চক্রবর্তী। অসুস্থ ছিলেন বেশ কিছুদিন ধরেই। ২০ অগস্ট দক্ষিণ কলকাতার রিজেন্ট পার্কের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক উৎপলেন্দু। বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। পরিচালক শতরূপা সান্যালের প্রাক্তন স্বামী এবং অভিনেত্রী ঋতাভরী চক্রবর্তী ও চিত্রাঙ্গদা চক্রবর্তীর বাবা উৎপলেন্দুর সঙ্গে অবশ্য তাঁর পরিবারের তেমন কোনও যোগাযোগ ছিল না।
ভারতীয় সংগীতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে ইন্দ্রপতন হল চলতি বছরেই। চলে গেলেন রাশিদ খান। কয়েক বছর ধরে শিল্পী প্রস্টেট ক্যানসারে ভুগছিলেন। তবে চিকিৎসায় সাড়াও দিচ্ছিলেন। এরই মধ্যে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (স্ট্রোক) হয়। সেখান থেকেই অবস্থার অবনতি শুরু। শিল্পীকে দক্ষিণ কলকাতার একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। সেখানেই ৯ জানুয়ারি বিকেল ৩টে ৪৫ মিনিটে প্রয়াত হলেন তিনি। বছর খানেক আগের কথা। সবে প্রকাশ্যে এসেছে পদ্ম পুরস্কারের তালিকা। সেখানে নাম থাকা সত্ত্বেও উস্তাদ রাশিদ খানের মন খারাপ। পরে জানা গেল পুরস্কারের তালিকায় উত্তরপ্রদেশের শিল্পী হিসেবে তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছিল। একটি সংবাদমাধ্যমকে রাশিদ বলেওছিলেন, ‘বছরের পর বছর আমি বাংলায় আছি। এটাই আমার কর্মস্থল। যেখানেই যাই সেখানে বাংলার শিল্পী হিসেবে যাই। এই সম্মান যদি বাংলার শিল্পী হিসেবে দেওয়া হত, তাহলে আরও ভালো লাগত।’
১৯৭০-এ সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিতে অভিনয় জীবন শুরু। ১৯৭১ সালেই মৃণাল সেনের ‘কলকাতা ৭১’-এ অভিনয়। দেবরাজ রায়ের নাম তখন মুখে মুখে ফিরছে। পরবর্তীতে অভিনয় করেন তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, বিভূতি লাহা-সহ সেই সময়ের খ্যাতনামী পরিচালকদের ছবিতেও। তপনবাবুর ‘রাজা’ ছবিতে তাঁর অভিনয় আজও মনে রেখেছেন সমঝদাররা। পর্দার পাশাপাশি মঞ্চেও দাপিয়ে অভিনয় করেছেন। দূরদর্শনের সংবাদপাঠক হিসেবেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন ৭৩ বছরের এই প্রবীণ অভিনেতা। ১৭ অক্টোবর তারার দেশে পাড়ি দিয়েছেন দেবরাজ।
মোদীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন বিবেক দেব রায়। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল ও প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তনী বিবেকের পরবর্তী পড়াশোনা দিল্লি স্কুল অফ ইকোনমিক্সে। পরে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। পয়লা নভেম্বর সকালে দিল্লি এইমসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান তথা দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ বিবেক দেবরায়। অর্থনীতির ছাত্র হলেও ইতিহাস, সংস্কৃতি, রাজনীতি-সহ আরও বহু ক্ষেত্রে পারদর্শী ছিলেন তিনি। অর্থনৈতিক সংস্কার, প্রশাসন এবং ভারতীয় রেলওয়ের মতো বিষয়গুলি নিয়ে নিরন্তর লেখালেখি করেছেন।
কলকাতা দূরদর্শনের জন্মলগ্ন থেকে পর্দায় তাঁর উপস্থিতি দেখে এসেছেন সমকালীন মানুষজন। আপাত রাশভারী হলেও ভিতরে ছিলেন মাটির মানুষ। পড়াশোনা করেছেন লেডি ব্রেবর্ন কলেজে। ১৯৭৪ সালে আকাশবাণী কলকাতার সংবাদ বিভাগে যোগ দেন সংবাদ পাঠক হিসাবে। পরের বছর যোগ দেন দূরদর্শনে। নিরাসক্ত হয়ে সংবাদ পাঠের একটা ধারা বজায় রেখেছিলেন বরাবর। সাদা-কালোর জমানায় যাঁদের দূরদর্শন দেখে বড় হওয়া তাঁরাই পেয়েছেন সেই স্বাদ। দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন ছন্দা সেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই ১২ সেপ্টেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
‘কাকাবাবু হেরে গেলেন’, ‘লাঠি’, ‘প্রেম আমার’-সহ একাধিক বাংলা ছবিতে পার্থসারথির অভিনয় করেছেন। ছোট পর্দার জন্য ‘সত্যজিতের গপ্পো’ সিরিজ়েও অভিনয় করেছিলেন। গত বছর ‘বগলা মামা যুগ যুগ জিও’ এবং ‘রক্তবীজ’ ছবিতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। সম্প্রতি স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয় পার্থসারথির। তারপর থেকে একাই থাকতেন। শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন বেশ কিছুদিন ধরেই। ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। ২৩ মার্চ রাতে সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন এই বর্ষীয়ান অভিনেতা। বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর।
কোচবিহারে মেয়ে, নাম ছিল আরতি ভৌমিক। ২০ বছর বয়সে তাঁর প্রথম ছবি ‘অনুষ্টুপ ছন্দ’ মুক্তি পায়। তবে প্রথম ছবি মুক্তির আগেই তিনি নাম বদলে হন অঞ্জনা। নিজের কেরিয়ারের অধিকাংশ ছবিই করেছেন মহানায়ক উত্তমকুমারের সঙ্গে। নেভি অফিসার অনিল শর্মাকে বিয়ে করেছিলেন অঞ্জনা। বিয়ের পর থেকেই আস্তে আস্তে সরে যান অভিনয় জগত থেকে। ষাট থেকে আশির দশকের বাংলা সিনেমায় ছিল তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। ‘চৌরঙ্গী’, ‘থানা থেকে আসছি’, ‘নায়িকা সংবাদ’-এর মতো ছবিতে তাঁর অভিনয় এখনও মনে রেখেছেন দর্শক। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা অসুখে ভুগছিলেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি ৭৯ বছরে চলে গেলেন বর্ষীয়ান অভিনেত্রী।
বিশিষ্ট পরিচালক মৃণাল সেনের হাত ধরে পরশুরাম ছবিতে মাত্র ১৬ বছর বয়সে অভিনয় শুরু করেছিলেন শ্রীলা। মৃণাল সেনের মোট ৬ ছবিতে অভিনয় করেছেন শ্রীলা। 'একদিন প্রতিদিন', 'খারিজ' ছবিতে মমতা শঙ্করের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। শ্যাম বেনেগালের 'আরোহন' ও মান্ডির মতো ছবিতে কাজ করেছেন। শাবানা আজমি, নাসিরুদ্দিন শাহ, স্মিতা পাতিলের মতো জাতীয় স্তরের অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন শ্রীলা, নিজের কেরিয়ারে জিতেছেন অসংখ্য পুরস্কার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন তিনি। বঙ্গবাসী কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ৩ বছর ধরে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করেছেন। শেষপর্যন্ত এই মারণ ব্যাধির কাছেই হার মানেন।