শেষ আপডেট: 14 July 2023 06:31
দ্য ওয়াল ব্যুরো: 'কোটায় (Kota) যাবে বলে ছেলে খুব উত্তেজিত ছিল। নতুন জামাকাপড় কিনেছিল, হাসি মুখে বাড়ি ছেড়ে কোটায় গিয়েছিল। কিন্তু ৪০ দিনের মাথায় তার নিথর দেহ বাড়ি ফিরল…', বলতে বলতেই কেঁদে ফেললেন সন্তানহারা এক মা!
গত ১১ মে, কোটায় উমেশ ভার্মা নামে এক ১৬ বছরের পড়ুয়া আত্মহত্যা (Kota Suicide) করে। কুনহারিতে একটি হস্টেলের ঘরে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার হয় উমেশের দেহ। ১০ মে থেকে একাধিকবার ফোন করেও ছেলেকে যোগাযোগ করতে পারেননি বাবা-মা। অগত্যা ছেলের খোঁজে এক আত্মীয়কে তার হস্টেলে পাঠান তাঁরা। সেই আত্মীয় ঘরে ঢুকে উদ্ধার করে মৃত উমেশকে।
উমেশের মা কান্না ভেজা গলায় বলতে থাকেন, 'এরা সকলে মিলে ছেলেকে মেরে ফেলেছে।' আত্মহত্যা কোটায় কোনও নতুন ঘটনা নয়। তা প্রতিরোধের জন্য কোটা জুড়ে নানান হেল্পলাইন নম্বর লেখা 'বিজ্ঞাপন'-এর ছড়াছড়ি। কোচিং সেন্টারে বিজ্ঞাপনের ভিড়ে এইসব বিজ্ঞাপনগুলোও উঁকি দেয়। সেখানে দাবি করা হয়, পড়ুয়াদের ২৪ ঘণ্টা পরিষেবা দেওয়া হবে। কোচিং সেন্টারগুলিও পেশাদার মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ করেছে, পুলিশও উদ্যোগ নিয়েছে আলাদাভাবে। তাও কি কমছে আত্মহত্যার সংখ্যা?
একটা পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। কোটায় নিট ও জেইই প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন পড়ুয়াদের মধ্যে চলতি বছরেই ১৪ জন আত্মহত্যা করেছে। তারমধ্যে মে-জুন মাসেই ৯ জন চরম পদক্ষেপ নিয়েছে।
কিন্তু কেন এই ঘটনা ঘটছে, এই প্রশ্নের উত্তর কিছুটা এড়িয়েই চলে কোটা শহর। কোটার এক স্থানীয় দাবি করেন, 'এখানে বছরে লক্ষাধিক পড়ুয়া পড়তে আসে, তারমধ্যে দু'একজন মারা গেলে এটা বড় কি ব্যাপার?' হয়তো পরিসংখ্যানের হিসেবে খুব একটা বড় নয় ঠিকই, কিন্তু কোটার এই সমস্যাই সবচেয়ে বড়! 'সংবাদমাধ্যম' থেকে কোটা শহর যেন পালিয়ে বেড়ায়।
অনেকে আবার আত্মহত্যার কারণ হিসেবে অভিভাবকদেরই কাঠগড়ায় তুলছেন। ল্যান্ডমার্ক সিটি হোস্টেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ভগবান বিড়লা বলেন, 'কোনও বাচ্চা ছোট থেকে স্কুলে টপ করলেই, অভিভাবকদের মধ্যে তাকে নিয়ে আলাদা প্রত্যাশা তৈরি হয়। কিন্তু সেই বাচ্চা যখন কোটায় আসে, তখন সে বাস্তবের মাটিতে নেমে আসে। বুঝতে পারে এই প্রতিযোগিতা সহজ নয়। তখন অনেক বাচ্চা বাড়ি ফিরে যায়, অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।'
তিনি আরও যোগ করেন, 'যে পড়ুয়াদের সাহায্যে আমাদের জীবিকা নির্বাহ হয়, তাদের ব্যাপারে আমাদের কেন কোনও অসৎ উদ্দেশ্য থাকবে? পরিবার সদস্যদের চাপ থাকে, সেটাই সহ্য করতে না পেরে ভেঙে পড়ে।'
উমেশ কি তেমনই তালিকায় ছিল? উত্তরপ্রদেশের খুরজা থেকে কোটায় এসেছিল সে। মাঝে কেটেছিল মাত্র ৪০ দিন, আর তারপরই সব শেষ! ছেলের মৃত্যু এভাবে মেনে নিতে পারছেন না উমেশের মা। তাঁর কথায়, 'আমার ছেলে পড়াশোনায় ভাল ছিল। মেডিকেল এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমরা কোটায় মাসে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে তাঁর থাকা-খাওয়া-লন্ড্রির সব ব্যবস্থা করেছিলাম।'
তারপরই তিনি বলেন, 'মৃত্যুর দু'দিন আগেই ছেলে বলেছিল, মাথা ব্যথা করছে, সেইজন্য তেলও কিনে এনেছে। ওষুধও খাচ্ছে। কিন্তু তারপর সব শেষ হয়ে গেল আমার।' উমেশ কেন এমন করল, সেই কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, পড়াশোনা নিয়ে শিক্ষকদের কাছে বকাঝকা খেয়েছিল। এমনকী উমেশকে শুনতে হয়েছিল, 'তুমি তোমার বাবা-মায়ের টাকা নষ্ট করছ কেন?' সম্ভবত সেটাই আত্মহত্যার কারণ। উমেশের মায়ের কথায়, 'কোচিং সেন্টার, হোস্টেলের লোকেরা সবাই মিলে আমার ছেলেকে মেরে দিয়েছে।'
উমেশের মতোই বিহারের রোহতাসে নিশান্তও একই পথ বেছে নিয়েছিল। তার মৃত্যুর পর একটি সুইসাইড নোট মিলেছিল। তাতে লেখা ছিল, 'মা-বাবা, তোমরা আমার জন্য অনেক কিছু করেছ। আমি পারলাম না। আমাকে ক্ষমা করে দাও।' কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী প্রায় সব জায়গা থেকেই ছেলেমেয়েরা এসে জড়ো হয় কোটায়। অনেকের ক্ষেত্রেই পরিণতি একই হয়।
কোটায় ছেলে-মেয়েদের একা ছেড়ে রাখলে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হতে পারে এই ভয়ে অভিভাবকদের মধ্যে কেউ কেউ সব ছেড়েছুড়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই কোটায় থাকতে শুরু করেন। আর তাই ১ বিএইচকে ফ্ল্যাটের চেইন তৈরি হয়েছে শহরে। কোটার প্রতিটি কোণে 'ভাড়ায় রুম'-এর হোর্ডিং রয়েছে, প্রতিটি ক্যান্টিনে 'ঘরে রান্না করা খাবার' প্রতিশ্রুতিযুক্ত পোস্টার দেখতে পাওয়া যায়। এটাই এখন কোটার নতুন ব্যবসা!
'কোটা ফ্যাক্টরি'! ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি নাকি শূন্যতার গহ্বর? 'ব্ল্যাক হোল' থেকে ফেরে কতজন?