শেষ আপডেট: 6th April 2023 10:54
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ন'বছরের ছোট্ট ছেলেটা টেলিস্কোপে চোখ রাখতে ভালবাসে। তার মনের আনাচ কানাচ জুড়ে জ্যোতিষ্করা জ্বলজ্বল করে। আকাশের চাঁদ-তারা তার কাছে কোনও রূপকথার গল্প নয়। মহাকাশ নিয়েই গবেষণা করতে চায় ছোট্ট আরুষ নস্কর। এই ন'বছর বয়সেই সে খুদে বিজ্ঞানী। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সম্মান পেয়েছে। নাসার (NASA) খুদে বিজ্ঞানীদের তালিকায় কলকাতার আরুষও একজন। বলা বাহুল্য, ভারতে এখন নাসার কনিষ্ঠতম 'সিটিজেন সায়েন্টিস্ট' (Citizen Scientist) সেই।
আরুষের মতো ছেলেমেয়েরা যেখানে মোবাইল গেম নিয়ে ব্যস্ত, সেখানে এই ছোট্ট ছেলেটা মহাকাশ বিজ্ঞানের জটিল অধ্যায় ঘাঁটাঘাঁটি করা শুরু করেছে। সে আকাশের চাঁদ-গ্রহ-নক্ষত্র দেখে আনন্দ পায়। টেলিস্কোপে চোখ রেখে 'নিয়ার আর্থ অবজেক্ট' অর্থাৎ পৃথিবীর কাছাকাছি থাকা গ্রহাণু (Asteroid), মহাজাগতিক বস্তুদের খোঁজ করে। মহাকাশে অসীম শূন্যে রহস্যের খোঁজ করাতেই তার আনন্দ। আরুষের বাবা কলকাতা অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারের সিটিজেন সায়েন্টিস্ট অনুপম নস্কর। বাবাকে দেখেই ছোট থেকে মহাকাশে আগ্রহ আরুষের। বাবার কাজ দেখতে দেখতে কখন যেন ছোট্ট আরুষও মহাকাশে গ্রহ-নক্ষত্রদের জগতে ঢুকে গেছে। মহাকাশ বিজ্ঞানের জটিল কাজকর্ম নিয়ে উৎসাহ দেখাচ্ছে।
অনুপমবাবু জানালেন, নাসার সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসটেরয়েড সার্চ কোলাবোরেশন (International Astronomical Search Collaboration (IASC)-এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরুষ। নাসা তার বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রকে সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে দিয়েছে। ছোটদের নিয়ে মহাকাশ বিজ্ঞান বিষয়ক নানা ক্যাম্পেন, ওয়ার্কশপ করে নাসা। ছোটরা ভাল কাজ করলে পুরস্কারও দেওয়া হয়। অ্যাস্টেরয়েড সার্চ কোলাবেরশনে নাসা মহাকাশে নতুন গ্রহ, গ্রহাণু বা মহাজাগতিক বস্তুদের শণাক্তকরণ, তাদের নামকরণ করার সুযোগ দেয়। বিশ্বের নানা দেশে নানা প্রান্তে অনেক পড়ুয়াই এই ক্যাম্পেনের সঙ্গে যুক্ত। আরুষও তাদের মধ্যে একজন।
মহাকাশে গ্রহ-নক্ষত্র বিষয়ক গবেষণার কাজে অনুপমবাবুরও নিজস্ব টিম আছে। গ্রহাণুদের অবস্থান, শনাক্তকরণ , নামকরণের প্রাথমিক কাজ করে থাকে আরুষ ও চার জন। ওই টিমের প্রধান অনুপমবাবু নিজে। দলে আছেন প্রবাস, বিশ্বেন্দু এবং তথাগত। সবাই চাকরি করেন। আরুষ সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। অনুপম বাবুদের টিম ১১টি নতুন গ্রহাণুর খোঁজ দিয়েছে। যার মধ্যে ৫টি গ্রহাণুর আবিষ্কারক আরুষ।
সাউথ পয়েন্ট স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আরুষ নস্কর। আরুষের যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন প্রথম কলকাতা থেকে চন্দ্রগ্রহণ দেখে সে। ছ'বছর বয়সে কেরল ঘুরতে গিয়ে সেখান থেকে বলয়গ্রাস সূর্য গ্রহণ দেখে। সেই সময় থেকেই ছোট্ট আরুষের মনে মহাকাশ নিয়ে কৌতুহল জন্মায়। তার সব কৌতুহলী প্রশ্নের উত্তর সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন বাবা অনুপম নস্কর। তাতে আগ্রহ আরও বাড়ত আরুষের। বাবার পাশে থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ দেখত, শেখার চেষ্টা করত। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটার-ইন্টারনেটের সঙ্গে পরিচয় হয়। নাসা, ইসরোর ওয়েবসাইট চষে ফেলে ছোট্ট ছেলেটা। টেলিস্কোপ নিয়ে ইন্টারনেটে পড়াশোনা করে। গ্রহাণুদের নিয়ে পড়তে শুরু করে। ইন্টারনেট থেকেই নাসার সিটিজেন সায়েন্টিস্ট ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে আরুষ। পাশে থেকে সাহায্য করেন বাবা অনুপম নস্কর।
অনুপম বাবু জানিয়েছেন, মহাকাশ বিজ্ঞানের গবেষণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে নাসা। সাধারণ মানুষকেও বিজ্ঞান গবেষণার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে নানা ক্যাম্পেনের মাধ্যমে। তার একটি হল সিটিজেন সায়েন্টিস্ট। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে বসানো বিশাল দুটি টেলিস্কোপ প্যান স্টার ১ ও ২ থেকে পাঠানো ফাইল চিত্র ঘেঁটে মহাকাশে গ্রহাণু ও মহাজাগতিক বস্তুদের শণাক্তকরণ করা হয়। পুরো কাজটাই হল কম্পিউটার অ্যালগোরিদমে। মহাকাশে এ যাবৎ যত গ্রহাণু বা নিয়ার আর্থ অবজেক্ট দেখা গেছে তাদের তালিকা তৈরি করেছে নাসা। সেইসব গ্রহাণুদের নামকরণও হয়েছে। তাছাড়া টেলিস্কোপে নতুন যেসব মহাজাগতিক বস্তু চিহ্নিত করা হয় তাদের শণাক্তকরণ ও নামকরণের দায়িত্ব দেওয়া হয় ক্যাম্পেনে অংশগ্রহণকারীদের। তাদের কাজ হয় এইসব নতুন মহাজাগতিক বস্তুদের চিহ্নিত করা, পৃথিবীর নানা জায়গায় বসানো বিভিন্ন টেলিস্কোপের মাধ্যমে নতুন গ্রহাণুদের উপর নজর রাখা, তাদের গতিবিধি পরীক্ষা করা। কোন গ্রহাণু পৃথিবীর কাছাকাছি এসে পড়ছে, কোনটা কত দূর দিয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি দেখে রিপোর্ট বানানো। এই কাজ যারা করে তাদেরই বলে সিটিজেন সায়েন্টিস্ট।
দুই সূর্য, রাত নামে না এই গ্রহে! বিস্ময় খোঁজ ১৭ বছরের কিশোরের, উল্লাস নাসার
সারা বিশ্বে এমন অনেক সিটিজেন সায়েন্টিস্ট আছেন যাঁরা বাড়িতে বসেই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিজ্ঞান সংস্থার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। নীরবে সাহায্য করে চলেছেন মহাকাশবিজ্ঞানীদের। আমাদের দেশেও ধীরে ধীরে এমন সিটিজেন সায়েন্টিস্টদের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন অনুপমবাবু। আরুষ এখনও অবধি ভারতে সবচেয়ে ছোট সিটিজেন সায়েন্টিস্ট। এই বয়সেই প্রায় ১০০০ গ্যালাক্সির শ্রেণিবিভাগ করে ফেলেছে সে।
ধূমকেতু বা গ্রহাণুর মতো মহাজাগতিক বস্তুরা পৃথিবীর কাছাকাছি চলে এলে বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এমন এক চাদর যা মহাজাগতিক বস্তু বা মহাজাগতিক রশ্মির হাত থেকে পৃথিবীর পিঠকে রক্ষা করে চলে। চাঁদে এই বায়ুমণ্ডল নেই। তাই মহাজাগতিক রশ্মিরা সরাসরি চাঁদের মাটিতে আছড়ে পড়ে। গ্রহাণু বা ধূমকেতুর সঙ্গে বায়ুর কণার ঘর্ষণ হলে তাতে আগুন ধরে যায়। অনেক সময় দেখা যায় গ্রহাণু বা ধূমকেতু থেকে ছিটকে বের হওয়া অংশের সঙ্গে বায়ুর ঘর্ষণে আগুনের ফুলকি তৈরি হয়েছে। সেইসব টুকরো জ্বলতে জ্বলতে পৃথিবীর মাটিতে নেমে এসেছে। একেই বলে উল্কাবৃষ্টি। মহাকাশে অবিরাম ঘটে চলা এইসব ঘটনা আকর্ষণ করে আরুষকে।
কেপলার মিশনের এতদিনের পুরনো পদ্ধতির বদলে ভিন গ্রহ খুঁজতে নতুন প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হয়েছে। নতুন এই টেকনিকের নাম ‘ট্রানসিট লিস্ট-স্কোয়ার্স সার্ভে।’ নাসার টেস টেলিস্কোপেও উন্নত পদ্ধতিতে গ্রহ-নক্ষত্রের অনুসন্ধান করা হয়। গবেষকদের দাবি, অনেক দ্রুত ও নিখুঁত ভাবে ভিন গ্রহের খোঁজ দিতে পারে টেস টেলিস্কোপ। ইতিমধ্যেই নাসার ‘প্ল্যানেট-হান্ট’ মিশনে জানা গেছে, আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরে প্রায় হাজার চারেক গ্রহ ছড়িয়ে রয়েছে। যারা সবকটি পাক খাচ্ছে কোনও না কোনও নক্ষত্রের চারপাশে। এই গ্রহগুলির মধ্যে ৯৬ শতাংশের আকার পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশি। আমাদের সৌরমণ্ডলের মতোই মহাকাশে ছড়িয়ে রয়েছে এমন আরও সৌরমণ্ডল। বিজ্ঞানীরা হন্যে হয়ে সেইসব অজানার খোঁজ করে চলেছেন। আরুষের মতো ছাত্র বা ছাত্রীরা কুসংস্কারহীন বিজ্ঞান মন নিয়ে যদি এগিয়ে যায়, তাহলে আমাদের দেশও মহাকাশ গবেষণার দিকে আরও অনেক বেশি এগিয়ে যাবে।