শেষ আপডেট: 4th September 2024 09:15
দ্য ওয়াল ব্যুরো: আরজি কর হাসপাতালে তরুণী পড়ুয়া-চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার তদন্তে নেমে প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে জেরাই করেনি কলকাতা পুলিশ। এর পরে তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে গেলে, তাদের স্ক্যানারে প্রথম নাম উঠে আসে সন্দীপের। টানা ১৬ দিন তাঁকে জেরা করে সিবিআই। এর মধ্যেই, খুন-ধর্ষণের পাশাপাশি আরজি করে বিপুল আর্থিক দুর্নীতি মামলাতেও নাম জড়ায় তাঁর। সেই মামলাতেই শেষমেশ সোমবার গ্রেফতার হয়েছেন তিনি।
কিন্তু এর মধ্যেই জানা গেছে, এই আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ সন্দীপের বিরুদ্ধে আগেও উঠেছে। বারবারই উঠেছে। কিন্তু কখনওই পদক্ষেপ করেনি প্রশাসন। এতেই প্রশ্ন উঠেছে, কোনও কারণে কি সন্দীপ ঘোষকে আড়াল করার চেষ্টা করছিল সরকার? কোনও বিশেষ প্রভাবের কারণে কি তিনি বারবার ছাড় পেয়ে গেছেন পুলিশের হাত থেকে? অভিযোগ, তিনি আরজি করে যে অপরাধ-ব়্যাকেট চালাতেন, তা থেকে পাওয়া মোটা টাকা ওপরতলা পর্যন্ত ভাগ-বাটোয়ারা হতো।
সূত্রের খবর, গত বছর জুলাই মাসে দুর্নীতি বিরোধী ব্যুরো, ভিজিল্যান্স কমিশন এবং স্বাস্থ্যভবনে আরজি করের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জানিয়েছিলেন আখতার আলি। কিন্তু কোনও পদক্ষেপ তখন করা হয়নি। এখন শাসকদলের তরফে কুণাল ঘোষ প্রকাশ্যে বলেছেন, সে সময়ে পদক্ষেপ করলে আজ এই অস্বস্তিতে পড়তে হতো না।
শুধু তাই নয়, এপ্রিলেই সন্দীপের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছিল টালা থানায়। তদন্তও শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেই তদন্তে তখনই সন্দীপ ঘোষকে ক্লিনচিট দিয়েছিল টালা থানা। এর একমাস আগে, মার্চ মাসে সন্দীপের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ নিতেই চায়নি টালা থানা। শেষমেশ কোর্টে অভিযোগ জমা পড়ে এপ্রিলে। কিন্তু মেলে ক্লিনচিট।
তবে এখন সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমে একের পর এক ভয়াবহ তথ্য পেয়েছে সিবিআই। যার জেরে গ্রেফতার করে, হেফাজতে নিয়ে জেরা করা হচ্ছে তাঁকে।
ঠিক কী কী অভিযোগ রয়েছে আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষর বিরুদ্ধে?
আরজি করের প্রাক্তন ডেপুটি সুপার, বর্তমানে বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজের ডেপুটি সুপার আখতার আলির দাবি, "নিজের দুর্নীতির রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে সন্দীপ ঘোষ হাসপাতালটাকে শুড়ি খানা বানিয়ে ছিলেন। হাসপাতালের গেস্ট হাউসে ছাত্রদের মদ্যপান করাতেন। হাসপাতালের যে কোনও কাজের টেন্ডারে ২০ শতাংশ করে নিতেন। এমনকী ক্যান্টিন, স্টল, সুলভ শৌচালয়গুলিকে টাকার বিনিময়ে অন্যদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।"
শুধু তাই নয়, হাসপাতালের ব্যবহৃত সরঞ্জামেও বিস্তর দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে। বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজের ডেপুটি সুপার আখতার আলির অভিযোগ, "একদিন অন্তর হাসপাতালের ব্যবহার হয়ে যাওয়া সিরিঞ্জ, স্যালাইনের বোতল, রবার গ্লাভস, হ্যান্ড গ্লাভস- সহ বিভিন্ন বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য মিলিয়ে প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ কেজি মাল বেরোত। এগুলোতেও দুর্নীতি করতেন সন্দীপ ঘোষ। একটা ব়্যাকেট বানিয়ে নিয়েছিলেন, তাতে যুক্ত ছিলেন দু'জন বাংলাদেশিও। তাঁরা এখান থেকে মালগুলো বাংলাদেশে নিয়ে যেত রিসাইকেল করার জন্য।"
এখানেই শেষ নয়! আরজি করের প্রাক্তন ডেপুটি সুপারের আরও অভিযোগ, "ওই সময় আমরা কয়েকজন এটা নিয়ে চিৎকার করাতে চাপে পড়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ। আমিও ছিলাম তদন্ত কমিটিতে। যেদিন আমরা তদন্ত রিপোর্ট জমা দিলাম, সেদিনই আমি বদলি হয়ে গেলাম। পরে তদন্ত কমিটির বাকি দু'জনকেও বদলি করে দেয়। সেই রিপোর্ট আজও সামনে আসেনি।"
এমনকী মর্গ থেকে লাশ পাচারের অভিযোগও রয়েছে আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষর বিরুদ্ধে। সূত্রের খবর, দেহাংশ কেটে বিক্রি করার একটা চক্র কাজ করত। সেগুলি বেসরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হত। এর পেছনে মোটা টাকার লেনদেন করা হত। এছাড়াও, অভিযোগ, প্রতিটি দেহ ছাড়ার বিনিময়ে পরিজনদের কাছ থেকে মোটা টাকা দাবি করা হত। আর সেই টাকা হাত ঘুরে যেত ওপরতলায়। তদন্তে এসবই খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
ইতিমধ্যে ডাক্তারি ছাত্রী খুনের ঘটনা নিয়ে প্রশ্নের মুখে সন্দীপ ঘোষ। অভিযোগ, খুনের ঘটনাকে ধামাচাপা দিয়ে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। নির্যাতিতার পরিবার এ ব্যাপারে সরাসরি এও অভিযোগও করেছেন, যে সম্ভবত হাসপাতালের কোনও দুর্নীতি মেয়ে জেনে ফেলেছিল বলেই হয়তো তাঁকে এভাবে হত্যা করা হল।
এই পরিস্থিতির মধ্যেও, বিক্ষোভের মুখে সন্দীপ ঘোষ আরজি কর থেকে পদত্যাগ করার পরে, একবেলার মধ্যে তাঁকে ন্যাশনাল মেডিক্যালের অধ্যক্ষ পদ দেওয়া হয়েছিল ১১ অগস্ট। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে জানান সে কথা, বলেন, 'সন্দীপ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, ওকে আমরা অন্য কোথাও পোস্টিং দেব।'
এই ঘটনায় ফের প্রশ্ন ওঠে, সন্দীপ ঘোষকে পদ দেওয়ার জন্য কেন মরিয়া ছিল রাজ্য সরকার! তবে সিবিআই তদন্ত শুরু হওয়ার পরেই অবশ্য তড়িঘড়ি সিট গঠন করে তদন্ত শুরু করে রাজ্য সরকারও। শেষমেশ তিনি গ্রেফতার করার পরে সন্দীপ ঘোষকে সাসপেন্ড করেছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর।