গ্রাফিক্স: শুভম সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: 9th February 2025 18:15
রূপক মিশ্র
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের তরফে একটি সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনেকেই গান গাইল, বাজনা বাজাল। কিন্তু অধ্যাপক বসুর মনে ধরল একজনকেই… সেই ছেলেটি, যে সেতার বাজিয়েছে।
অনুষ্ঠান শেষ। সবকিছু গোছাগোছ চলছে। অতিথিরা একে একে বিদায় নিলেন। মাস্টারমশাইয়ের কিন্তু আশ মেটেনি। ফিজিক্সের সমীকরণ মাথায় থাক৷ ওই সেতার ফের একবার না শুনলে তিনি চক হাতে ব্ল্যাকবোর্ড পর্যন্ত বুঝি যেতে পারবেন না!
সেদিন সম্ভব ছিল না। কিন্তু পরদিনই ওই ছাত্রটিকে নিজের ল্যাবে ডেকে পাঠালেন।
‘তোর বাজানো বড্ড ভাল লেগেছে। আরেকটিবার শোনাতে পারবি?’
‘পারব স্যার। কিন্তু সেতার তো বাড়িতে। কাল আনি?’
‘উঁহু। কাল নয়। আজ, এক্ষুনি। যা চটপট নিয়ে আয়।’
তর সইছিল না প্রোফেসর বসুর। একপ্রকার জোর করেই সেতার আনালেন। তারপর ল্যাবরেটরি বদলে গেল সংগীতের আসরে। মেঝেতে ঠিক জমছিল না। তাই ব্যবস্থা হল বড় মাপের টেবিলের৷ চাদর বিছিয়ে আয়েশ করে বসে পড়ল সেতারবাদক ছাত্র। সামনে চেয়ার পেতে গুণমুগ্ধ অধ্যাপক। আলাপের ছড় টানা শুরু হতেই চোখ বুজে ফেললেন তিনি। খুললেন আভোগ শেষে।
গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে যাঁর বিহার, তাঁরই আরেক বিচরণভূমি ছিল সুরের জগৎ। তত্ত্বীয় ফিজিক্সের কূটাভাষ ও এস্রাজের তারে রাগের ওঠানামা মিলে গিয়েছিল এক অনির্দেশ্য টানে! আপাতদৃষ্টিতে দুটো দুনিয়া ভিন্ন ধাঁচের, ভিন্ন গতের মনে হলেও বিজ্ঞানী, অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর চোখে পদার্থবিদ্যা ও সঙ্গীতের সফর ছিল এক সুতোয় গাঁথা। বিজ্ঞানের যুক্তির প্রতি প্রেম ও ধ্রুপদী বাদ্যযন্ত্রের আসক্তির মধ্যে তিনি বিরোধ খুঁজে পাননি। কেউ পদার্থবিদ্যায় দড় হলেও তাঁর পক্ষে সুর-রসিক হতেই বা বাধা কোথায়? প্রশ্নের জবাব নিজেই দিয়েছিলেন এভাবে: ‘গানের ব্যাপারে আমার নিজের কোন বর্ণপরিচয় ছিল না। একটা ছোট এস্রাজ কিনে নিজে নিজে বাজাবার চেষ্টা করা হলো। অবশ্য স্বরলিপি দেখে বাজাবার অভ্যাস করতে হয়েছিল। তাছাড়া বিজ্ঞানী লোক হিসেবে ইংরেজীতে যাকে বলে harmonics সে সবগুলো অনুসন্ধান করে তার দ্বারা কী করে এ বাজানো যায় এইসব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা নানান রকমের করা যেত; এইভাবে এসরাজের সঙ্গে পরিচয়।’
অর্থাৎ, হারমনিক্সে ব্যুৎপত্তি থাকার কারণে সুর ও বিজ্ঞানের এই সেতুটি খুব সহজেই তৈরি হয়েছিল। সংগীতের বাদী-বিবাদীর খেলা মিলে গিয়েছিল সুরবিজ্ঞানের ফার্স্ট হারমোনিক-সেকেন্ড হারমোনিকের অঙ্কে।
সত্যেন্দ্রনাথ সেতার, সরোদ সবই শুনতেন৷ কিন্তু নিজের পছন্দের বাদ্যযন্ত্রটি ছিল এস্রাজ৷ কুড়ি-একুশ বছর বয়সে ছোট মাপের একটি এস্রাজ পান। বহুদিন পর্যন্ত তাই বাজিয়েছেন। কিন্তু কাজের সূত্রে পূর্ববঙ্গে যাওয়ার পর হাত আরও পরিণত হয়। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এমন সময় এক ছাত্র তাঁকে বেশ দামি গোছের এস্রাজ উপহার দেয়। ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে তখন হরেক কিসিমের গান-বাজনার, সুর নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার ঢেউ এসেছে। সত্যেন্দ্রনাথ নিজেও তাতে গা ভাসালেন। তাঁকে টানল রাসের আসর৷ বৈষ্ণবীদের বাড়িতে গানবাজনা বসত। যেখানে আসতেন ভগবান সেতারি, শ্যাম সেতারির মতো দিগগজ ওস্তাদেরা। অধ্যাপক বসুও যেতেন সেখানে। বাজাতেন যত, শুনতেন তার চেয়ে বেশি৷
বস্তুত, এই শোনার আগ্রহই তাঁর সাংগীতিক অভিরুচি তৈরি করে। বাড়িতে সুরসাধনার চল ছিল না। গানবাজনা বাবা সুরেন্দ্রনাথ বসুর বিলকুল নপসন্দ৷ অথচ ছেলে মজে রয়েছে সংগীতের অমোঘ অভিসারে! এই সময় কিশোর সত্যেনকে সংকট থেকে উদ্ধার করেন তাঁর বন্ধুরা। গিরিজাপতি ভট্টাচার্য সত্যেন্দ্রনাথের আবাল্য হরিহর আত্মা। কাছেই বাড়ি। আর সেখানেই বসত আয়োজন। যোগ দিতেন অগ্রজ, অনুজদের অনেকে৷ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র, সুগায়ক ও সুলেখক দিলীপকুমার রায় সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পরম সুহৃদ। গিরিজাপতির আসরে তিনিই ছিলেন মধ্যমণি। আর ছিলেন শোভবাজার রাজপরিবারের সন্তান হারীতকৃষ্ণ দেব। উদাত্ত, দরদী তাঁর গানের গলা। রাজবাড়ির গৌরবশশী ততদিনে অস্তমিত। তবু উনিশ শতকীয় কৌলীন্যকে ধরে রেখেই মাঝেমধ্যে জলসার আয়োজন বসত। দেশের তাবড় তাবড় সংগীতগুরুরা আমন্ত্রিত হতেন। সেখানে শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত থাকতেন সত্যন্দ্রনাথও। মার্গ সংগীতের রাগ-রাগিনীর উৎসাহ মিটিয়েছিলেন আরও এক বন্ধু। মানিকলাল দে। তাঁর আমন্ত্রণে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের একাধিক অনুষ্ঠানে অতিথি হন সত্যেন্দ্রনাথ।
হাতে এস্রাজ তুলে নেওয়ার আগে এভাবেই নিজের শোনার কানকে প্রস্তুত করেছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে সঞ্চয় করেন সাহস। কর্নওয়ালিস স্কোয়ার বা হেদুয়ায় বসা বন্ধুদের জমাটি আড্ডাকে আত্মপ্রকাশের মঞ্চ হিসেবে বেছে নেন। ভাঙতে থাকে আড়। যেহেতু ছেলেবেলায় সংগীতে প্রথাগত হাতেখড়ি হয়নি, তাই স্বভাবতই কিছুটা গুটিয়ে থাকতেন কিশোর সত্যেন।
এই সময় সাহস জোগান দিলীপকুমার। সত্যেন্দ্রনাথের পরম আদরের ‘মন্টু’। ঢাকায় এলে বন্ধুর বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও উঠতেন না দিলীপ। নিজে গান গাইতেন। আর সত্যেনকে বলতেন, ‘ঝটপট এস্রাজ নিয়ে আয়। শুরু কর বাজানো।’ দিলীপকুমার রায় তাঁর বন্ধু সম্পর্কে বলেছিলেন, "গানের সে এক খাঁটি সমজদার, ভালো গান শুনবামাত্র এক আঁচড়েই ভালো বলে চিনে নিতে পারত।" কথাটি পুরোপুরি সত্য। আর এর অন্যতম কারণ, ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের রাগরাগিনী বিষয়ে সত্যেন্দ্রনাথের নিবিড় জ্ঞান, নিরলস অধ্যয়ন। এই প্রজ্ঞার গভীরতা উপলব্ধি করেছিলেন অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও। ‘Indian Music: An Introduction’ নামে সঙ্গীত বিষয়ে একটি প্রামাণ্য গবেষণা গ্রন্থ লেখেন তিনি। সেটা লেখার সময় সত্যেন বসুর থেকে অনেক পরামর্শ নেন ধুর্জটিপ্রসাদ।
সংগীতের রসজ্ঞ সমঝদার হিসেবে অল্পদিনেই সুনাম কুড়িয়েছিলেন সতেন্দ্রনাথ। ধীরে ধীরে বাড়ছিল আত্মবিশ্বাস। যে কারণে কিছুকাল বাদেই ঢাকার ‘ঝঙ্কার সঙ্গীতচক্রে'র সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। পরে ‘ক্যালকাটা অ্যাকাডেমি অফ ইন্ডিয়ান মিউজিকে'র সভাপতি নির্বাচিত হন।
সংগীতজগতের উপরিতলে ঘোরাফেরা করলেও সত্যেন বসু কিন্তু শিকড়কে ভুলে যাননি। একদিন পাড়ার যে জলসা, ঘরোয়া আড্ডা তাঁর সাংগীতিক রুচি তৈরি করেছিল, তাদের বিস্মৃত হননি কোনওদিন। তাই ছোটখাট ক্লাবের অনুষ্ঠানেও শ্রোতার আসনে তাঁকে দেখা যেত। ঢাকায় থাকতে ছাত্রদের গানবাজনার আসর এড়িয়ে যেতেন ঠিকই। কিন্তু কলকাতায় আসার পর তা বদলে যায়। গানের প্রতি আকর্ষণ এত তীব্র হয়ে ওঠে যে, পদের গরিমার তোয়াক্কা না করে বিনা আমন্ত্রণেও তিনি বেশ কিছু অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতেন।
এমনই একটি আয়োজন ‘বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলন’। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রশতবার্ষিকী অধিবেশন আয়োজিত হয়েছে। প্রধান সভাপতি সত্যেন্দ্রনাথ বসু। উদ্যোক্তারা তাঁকে উদ্বোধনের দিন আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু শেষদিনের সংগীতানুষ্ঠান, যেখানে গান গাইবেন দিলীপকুমার রায়, তার জন্য কোনও আমন্ত্রণপত্র সত্যেন্দ্রনাথের কাছে আসেনি। আয়োজকেরা বেমালুম ভুলে যান।
অন্য কেউ হলে এর একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়তেন। কিংবা গোঁসা করে অনুষ্ঠানেই যেতেন না। কিন্তু আপনভোলা সত্যেন বসু এত জটিলতার ধার ধারেননি। প্রিয় মন্টুর গান শোনার সুযোগ হারাতে রাজি নন তিনি। তাই সটান গিয়ে হাজির৷ এদিকে দেরি করে পৌঁচেছেন। একটিও চেয়ার খালি নেই। বাধ্য হয়ে মাটিতে বিছানো সতরঞ্জিতেই বসে পড়েন কৃতবিদ্য অধ্যাপক, বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী! তাঁকে দেখতে পেয়েই উদ্যোক্তাদের মাথায় হাত। এতক্ষণে হুঁশ ফিরেছে। সকলে মিলে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে মঞ্চে আসন গ্রহণের অনুরোধ জানান। সেদিন তাঁদের আশ্বস্ত করেও সতরঞ্জি ছেড়ে ওঠেননি সত্যেন্দ্রনাথ। শুধু বলেছিলেন: ‘আজ আমি তোমাদের সভাপতি নই। আমি এসেছি বন্ধুর গান শুনতে। শুনেই চলে যাব।’
ম্যাক্স প্লাঙ্ক ছিলেন পিয়ানোবাদক। আর আইনস্টাইনের প্রীতি ছিল ভায়োলিনে। কোয়ান্টাম ফিজিক্সের বাইরে সুরের জগতেও সত্যেন্দ্রনাথ-আইনস্টাইনের পছন্দের মিল বেশ আশ্চর্যের! কখনও আইনস্টাইনের ভায়োলিন শুনেছেন? একটি রেডিও কথিকায় প্রশ্নটি করা হলে সত্যেন্দ্রনাথের সহাস্য জবাব ছিল: ‘গুরুর বাজনা? আইনস্টাইন সাহেবের বাজনা শুনিনি। যদিও অনেক সময়ে তাঁর ঘরে দেখেছি বেহালা রয়েছে। কখনও সাহস করে তাঁকে অনুরোধ করতে পারিনি যে, আমাকে একটু বাজনা শোনান।’
ঋণ:
১. 'এসরাজ প্রসঙ্গে', সত্যেন্দ্রনাথ বসু রচনা সংকলন, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা, ১৯৯৮।
২. ‘বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু’, রবীন বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানী, কলকাতা-৯, ১৯৬০।