সঞ্জয় রায় এবং বিচারক দাস
শেষ আপডেট: 21st January 2025 10:57
দ্য ওয়াল ব্যুরো: অনেকেরই ধারণা ছিল আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসক পড়ুয়ার খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়কে মৃত্যুদণ্ডই দেবে আদালত। কিন্তু শেষমেশ দেখা যায়, শিয়ালদহ আদালতের বিচারক অনির্বাণ দাস তা করেননি। বরং রায় ঘোষণা করতে গিয়ে তিনি স্পষ্ট ভাবেই জানিয়েছেন, সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ দেখে তাঁর মনে হয়নি, এটা বিরলতম বিরল অপরাধ।
এদিন রায় ঘোষণা করতে গিয়ে বিচারক বলেন, “বিচার ব্যবস্থার প্রধান দায়িত্ব হল আইনের শাসনকে রক্ষা করা এবং প্রমাণের ভিত্তিতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, জনমতে বয়ে যাওয়া নয়। নিরপেক্ষতা এবং পক্ষপাতহীন থাকা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। বিচার চলাকালীন কী তথ্য প্রমাণ ও সাক্ষ্য পেশ করা হচ্ছে তার উপর ভিত্তি করেই রায় দেওয়া হয়, জনমত বা আবেগের প্রভাবে নয়। পাশাপাশি, আদালতকে অভিযুক্তের অধিকার এবং পরিস্থিতির কথাও মাথায় রাখতে হয়। এও বিবেচনা করতে হয় যে এই রায়ের কী বৃহত্তর প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে এই মামলায় উল্লেখযোগ্য যে, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে পূর্বে কোনও অপরাধমূলক আচরণ বা দোষের প্রমাণ নেই”।
রায় ঘোষণা করতে গিয়ে বিচারক অনির্বাণ দাস আরও বলেন, “আধুনিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে আমাদের উচিত ‘চোখের বদলে চোখ’ বা ‘দাঁতের বদলে দাঁত’ বা ‘নখের বদলের নখ’ বা ‘প্রাণের বদলে প্রাণ’- এর মতো প্রাচীন প্রতিশোধমূলক প্রবৃত্তি থেকে উপরে ওঠা। আমাদের দায়িত্ব হল বর্বরতাকে বর্বরতা দিয়ে মোকাবিলা না করে, জ্ঞান, সহমর্মিতা এবং ন্যায়ের গভীরতর উপলব্ধির মাধ্যমে মানবতাকে উন্নীত করা। একটি সভ্য সমাজের মানদণ্ড প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতায় নয়, বরং সংস্কার, পুনর্বাসন এবং সর্বোপরি আরোগ্যের ক্ষমতায় নিহিত”।
রায় ঘোষণা প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক বচ্চন সিং মামলার প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন বিচারক। রায় ঘোষণা করতে গিয়ে বিচারক বলেন, “এটি স্পষ্ট যে, এই মামলা "সবচেয়ে বিরল" মানদণ্ডে পড়ে না”। তাঁর কথায়, “সুপ্রিম কোর্ট বারবার বলেছে যে, মৃত্যুদণ্ড কেবল তখনই ব্যবহার করা উচিত যখন সমাজের সম্মিলিত বিবেক এতটাই ক্ষুব্ধ যে তারা বিচার দেওয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্তদের থেকে মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশা করে”।
বিচারক তাঁর রায়ে আরও বলেছেন, “এহেন পরিস্থিতিতে আদালত মনে করে, প্রসিকিউশনের মৃত্যুদণ্ডের আবেদনে সাড়া দেওয়া উপযুক্ত হবে না। এটা ঠিক যে ভুক্তভোগীর পরিবারের শোক ও কষ্ট অপরিসীম, কোনও সাজাই তা পুরোপুরি প্রশমিত করতে পারবে না, তবু আদালতের দায়িত্ব এমন একটি সাজা ঘোষণা করা যা অপরাধের গুরুত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, ন্যায়সঙ্গত এবং প্রতিষ্ঠিত আইনি নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ”।
বিচারক অনির্বাণ দাস বলেন, “সারসংক্ষেপে, এই মামলাটি এমন একটি রায় দাবি করে যা অপরাধের গুরুত্বের সঙ্গে ন্যায়বিচার, পুনর্বাসন এবং মানব মর্যাদা রক্ষার নীতিগুলিকে ভারসাম্যপূর্ণভাবে বিবেচনা করবে। আদালতের উচিত জনমতের চাপ বা আবেগময় আবেদনকে উপেক্ষা করা এবং একটি রায় দেওয়া যা বিচার ব্যবস্থার সততা রক্ষা করে এবং ন্যায়ের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষা করে”।
এ কথা বলার পরই বিচারক সঞ্জয় রায়কে আমৃত্যু কারাবাসের সাজা শুনিয়েছেন। তাঁর কথায়, সমস্ত পরিস্থিতি, ঘটনাটির সামাজিক প্রভাব এবং সামগ্রিক জনমতের বিষয়টি বিবেচনা করে নিম্নলিখিত রায় প্রদান করাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে আমি মনে করি। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী আজীবন সশ্রম কারাদণ্ড। এবং ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১০৩(১) নম্বর ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা।