প্রতীকী ছবি।
শেষ আপডেট: 30th August 2024 19:27
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ২০ দিন পার হয়ে আজ ২১তম দিন। আরজি করের নশংস ধর্ষণ-খুনের ঘটনার পরে তিন-তিনটে সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। একা সঞ্জয় ছাড়া আর কোনও অভিযুক্ত এখনও ধরা পড়েনি। অথচ সিবিআই তদন্তে প্রায় প্রতিদিনই উঠে আসছে কিছু না কিছু অসঙ্গতি। শুধু সিবিআই তদন্তে নয়, এই কেসের যে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা সুপ্রিম কোর্ট করছে, সেখানেও এই কেসের একাধিক অসঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রধান বিচারপতি, যার উত্তর দিতে গিয়ে রীতিমতো থতমত খেয়েছেন সরকারপক্ষের দুঁদে আইনজীবী কপিল সিবাল। যে জন্য বিচারপতি বলেছেন, পরেরবার দক্ষ কোনও পুলিশ অফিসার নিয়ে যেতে, যাতে গোটা ঘটনা ভাল করে বুঝিয়ে বলতে পারেন তিনি।
আরজি কর কাণ্ডের এমনই হাফ ডজন অসঙ্গতি খতিয়ে দেখল 'দ্য ওয়াল'। সঙ্গে দেওয়া হল ব্যাখ্যাও, যা মিলেছে পুলিশের তরফে বা অন্য কোনও সূত্রে।
প্রথম থেকেই নির্যাতিতার পরিবারের তরফে দাবি করা হয়েছে, তাঁদের ফোন করে বলা হয়েছিল, মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। খবর পেয়ে পৌঁছনোর পরে মেয়েকে দেখতেও দেওয়া হয়নি কয়েক ঘণ্টা, অভিযোগ করেছেন তাঁরা। এমনকি ঘটনার পরে সেদিন হাসপাতালে দাঁড়িয়েই নির্যাতিতার বাবা-মা বলেছিলেন, কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা হচ্ছে।পরে একাধিকবার তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, "কাকে আড়াল করা হচ্ছে? কেন, পুলিশি তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই হাসপাতালের তরফে বলা হয়েছিল মেয়ে সুইসাইড করেছে?"
প্রাথমিক ভাবে পুলিশের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠলেও, পরে পুলিশ নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে জানায়, ঘটনার দিন তাদের তরফে কোনও ফোন করা হয়নি পরিবারকে।
ইতিমধ্যে ঘটনার ৬ দিন পরে আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের চেস্ট মেডিসিনের এইচওডি ডাঃ অরুণাভ দত্ত চৌধুরী বলেন, 'ময়নাতদন্তের' আগেই এভাবে 'আত্মহত্যা' বলে মন্তব্য করা হয়ে থাকলে তা অন্যায় হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের কাছে অকপটে একথা জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, 'আমি ওই ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। মেয়েটির বাড়ির ফোন নম্বর জোগাড় করার পর সহকারী সুপার বাড়িতে ফোন করে মৃত্যুর খবর দিয়েছিলেন। তবে ময়নাতদন্তের আগে এভাবে না জেনে কেউ আত্মহত্যার কথা বলে থাকে তাহলে সেটা অন্যায় হয়েছিল।'
পরে সামনে আসে একটি অডিও ক্লিপ, যাতে নির্যাতিতার পরিবারকে হাসপাতালের এক মহিলা কণ্ঠ বলছেন, ‘ওঁর অবস্থা খুবই খারাপ। উনি সুইসাইড করেছেন হয়তো বা মারা গিয়েছেন।’ ওই মহিলা কণ্ঠ নিজেকে ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার’ হিসেবেও পরিচয় দিয়েছেন। ওই ফোন কে করেছিলেন, কেনই বা তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার সেজে আত্মহত্যার কথা বলেছিলেন, তা এখনও তদন্তাধীন।
৯ অগস্ট সকালে আরজি কর হাসপাতালে তরুণী পড়ুয়া-চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হওয়ার পরে একটি জেনারেল ডায়েরি করা হয় সকাল ১০টা ১০ নাগাদ। এর পরেই তড়িঘড়ি তরুণীর দেহের ময়নাতদন্ত করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা পরিষ্কার দেখা যাওয়ার পরেও এফআইআর দায়ের করা হয়নি কর্তপক্ষ। রাত ১১টায় নির্যাতিতার পরিবারের তরফে দায়ের হয় এফআইআর।
সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর মামলা চলার সময়ে প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় বলেন, রাজ্যের আইনজীবী কপিল সিবালকে বলেন, 'মিস্টার সিবাল, সবচেয়ে উদ্বেগের হল, ঘটনার জিডি এন্ট্রি হয়েছে ৯ অগস্ট সকাল ১০টা বেজে ১০ মিনিটে। আর ক্রাইম সিনকে সুরক্ষিত করা হয়েছে রাত সাড়ে ১১টার পর! এতক্ষণ ধরে কী চলছিল?'
প্রধান বিচারপতি এই উদ্বেগ প্রকাশের পরই সিবালকে উপর্যুপরি প্রশ্ন করেন বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা। এদিন সিবিআই ও রাজ্য সরকার দুজনেই আরজি কর কাণ্ড নিয়ে স্ট্যাটাস রিপোর্ট পেশ করেছে সুপ্রিম কোর্টে। সেই রিপোর্ট হাতে নিয়েই প্রশ্ন করতে থাকেন বিচারপতি পারদিওয়ালা। তিনি সিবালের উদ্দেশে বলেন, 'ময়না তদন্ত কখন হয়েছে?'
জবাবে কপিল সিবাল বলেন, ময়না তদন্ত হয়েছে সন্ধে ৬টা থেকে ৭টা নাগাদ। তা শুনেই বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা বলেন, 'ময়নাতদন্ত হয়েছে সন্ধে ৬টার সময়ে আর অস্বাভাবিক মৃত্যুর এফআইআর দায়ের হয়েছে রাত সাড়ে ১১টায়! আপনার রাজ্য যা করেছে, আমার ৩০ বছরের কর্মজীবনে এমনটা আমি কখনও দেখিনি! এফআইআর দায়ের করার আগেই ময়না তদন্ত হয়ে গেল!'
এই অসঙ্গতির কোনও সন্তোষজনক উত্তর এখনও আদালতে দিতে পারেনি রাজ্য প্রশাসন।
নির্যাতিতার পরিবারের তরফে প্রথম থেকেই দাবি করা হয়, তাড়াহুড়ো করে প্রমাণ লোপাট করার চেষ্টা করেছে পুলিশ। সে জন্যই ময়নাতদন্তের পরে তড়িঘড়ি দেহ সৎকার করে দেওয়া হয়। এমনকি শ্মশানে ওই তরুণীর আগে আরও দু'টি দেহ থাকলেও, লাইন ভেঙে আগে তরুণীর দেহ পোড়ানো হয় বলে দাবি করা হয় পরিবারের তরফে।
যদিও সোদপুরের শ্মশানের ম্যানেজার ভোলানাথ পাত্র পরে সংবাদমাধ্যমকে জানান, দেহটি ময়নাতদন্তের পরে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছিল, পচন ধরার সম্ভাবনা ছিল, সে জন্যই পোড়ানোর ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করা হয়। সেই সঙ্গেই তিনি জানান, অনেক পুলিশের গাড়ি ছিল, বহু মানুষ ভিড় করেছিলেন, সে জন্য ট্র্যাফিক জ্যামও হচ্ছিল শ্মশানের সামনের রাস্তায়। সেটাও তাড়াহুড়োর একটা কারণ। সেই সঙ্গেই তিনি বলেন, শ্মশানে তরুণীর পরিবারের তরফে এক দাদা উপস্থিত ছিলেন, তাঁর সম্মতি এবং স্বাক্ষর নিয়েই সৎকার করা হয় দেহ।
কলকাতা পুলিশের তরফেও সোশ্যাল মিডিয়ায় জানানো হয়, তরুণীর দেহ কলকাতা পুলিশ সৎকার করেনি, করেছে তার পরিবারই।
ঘটনার পরেই অভিযোগ উঠেছিল, আরজি করের থার্ড ফ্লোরের সেমিনার রুমে অর্থাৎ ক্রাইম সিনে নানা রকম পরিবর্তন ঘটেছে। এবার সামনে এল, সেদিনকার সেমিনার হলের একটি ভিডিও, যাতে এই অভিযোগেরই সত্যতা প্রমাণ হয় বলে মনে করছেন অনেকে। এই ভিডিওর সত্যতা অবশ্য যাচাই করেনি 'দ্য ওয়াল'।
তবে সেদিনের সেই ভিড়ের মধ্যেই এমন কিছু লোকজনকে দেখা গেছে, যা দেখে নতুন করে প্রশ্ন উঠে গেছে, ক্রাইম সিন আদৌ সুরক্ষিত ছিল কিনা, তাই নিয়ে! ভিডিওয় দেখা গেছে, ভিড়ের মধ্যে রয়েছেন হাসপাতালের ফরেন্সিক বিভাগের কর্তা দেবাশিস সোম। এই দেবাশিস সোম এখন সিবিআই তদন্তের স্ক্যানারে।
এছাড়াও ঘটনার দিনের ভাইরাল হওয়া ভিডিওয় দেখা গেছে, শান্তনু দে নামের এক আইনজীবী সেখানে উপস্থিত। তিনি সন্দীপ ঘোষের নিজস্ব আইনজীবী তথা ছায়াসঙ্গী বলে জানা গেছে।
সন্দীপ ঘোষের আর এক ছায়াসঙ্গী প্রসূন চট্টোপাধ্যায়কেও দেখা গেছে ওই ভিডিওর ভিড়ে। স্বাস্থ্য ভবনের একাংশের মতে, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে তিনি ডেটা এন্ট্রি অপারেটর হিসাবে কাজ করেন। সেই সঙ্গেই তাঁর আরজি করে আসা-যাওয়া ছিল সন্দীপ ঘোষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে।
ঘটনার দিন সকাল সকাল এই তিনজন কীভাবে পৌঁছে গেলেন ক্রাইম সিনে, সেকথা ভাবাচ্ছে সকলকে। তাও যদি ধরে নেওয়া যায়, প্রসূন চট্টোপাধ্যায় ও দেবাশিস সোম হাসপাতালেই ছিলেন কাজের সূত্রে, কিন্তু অত সকালে আইনজীবী সেখানে কী করছিলেন?
আইনজীবী শান্তনু দে অবশ্য একটি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তিনি অর্থোপেডিক বিভাগে ডাক্তার দেখাবেন বলে আউটডোরের টিকিট কাটতে গিয়েছিলেন।
পুলিশও অবশ্য জানিয়েছে, তাদের তরফে ৪০ ফুট কর্ডন করে রাখা হয়েছিল ক্রাইম সিন। ভিডিওয় যে ভিড় দেখা গেছে সেমিনার হলে, তা কর্ডনের বাইরে।
গতকাল, বৃহস্পতিবরাই নতুন করে সামনে এসেছে চাদর বিতর্ক। নির্যাতিতার মা-বাবা অভিযোগ করেছেন, মৃত্যুর আগে বা পরে মেয়ের শরীরে যে চাদর ছিল, তা পরে বদলে দেওয়া হয়েছে। এক সংবাদমাধ্যমে নির্যাতিতার বাবা দাবি করেছেন, হাসপাতালে যাওয়ার পর তাঁরা যখন মেয়ের দেহ দেখেছিলেন তখন তার গায়ের ওপর সবুজ চাদর ছিল। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে যে ছবি আগে দেখানো হয়েছে সেখানে চাদরের রং ছিল নীল। শুধু তাই নয়, ঘটনার আগের দিন রাত্রে মেয়ে লাল চাদর নিয়ে শুয়েছিল এমন খবরও তাঁরা পেয়েছেন বলে দাবি।
কলকাতা পুলিশের তরফে সবুজ চাদরের অস্তিত্ব খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। কলকাতা পুলিশের ডিসি সেন্ট্রাল। ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় বলেছেন, 'পুলিশের রেকর্ডে চাদরের রঙ নীল লেখা আছে। এখানে সবুজের কোনও উল্লেখ নেই।। ঘটনাস্থল থেকে অনেক কিছু বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে লাল চাদরও ছিল।'
তবে তদন্তকারীদের মনে উঁকি দিচ্ছে অন্য প্রশ্ন। সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, তাঁদের হাতে যে ভিডিও এসেছে তাতে নির্যাতিতার গায়ের চাদর দেখে মনে হচ্ছে, যেন কেউ পরিপাটি করে তা গায়ে রেখেছে! আর এখানেই খটকা লাগছে তদন্তকারীদের।
সিবিআইয়ের দাবি, এই ঘটনার প্রধান ও একমাত্র অভিযুক্ত সঞ্জয় রায় এখনও পর্যন্ত দোষ স্বীকার করেনি। বরং তদন্তকারী সংস্থা সূত্রের খবর, জেরায় ধৃত সঞ্জয় জানিয়েছে, এ বিষয়ে সে কিছুই জানত না। ঘটনার দিন সকালে হাসপাতালে ভর্তি এক পরিচিতকে দেখে করিডর দিয়ে ফেরার সময় সে খেয়াল করে, সেমিনার রুম খোলা। তখন সেটি নাকি ফাঁকাই ছিল।
অথচ আরজি করের ঘটনার পরের দিনই সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশ। তার ইয়ারফোনটি ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া যায়, সিসিটিভি ফুটেজেও তার উপস্থিতির প্রমাণ মেলে সে রাতে। তাকে গ্রেফতারের পর কলকাতা পুলিশ দাবি করেছিল, ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায় নিজের অপরাধ স্বীকার করেছে।
পুলিশের এই তথ্য একেবারেই মিলছে না সিবিআইয়ের সঙঅগে। তাই ঘটনার দিন রাতে তরুণীর সঙ্গে রাতের খাবার খাওয়া চার জুনিয়র চিকিৎসককেও ইতিমধ্যে জেরা করেছেন তদন্তকারীরা। ধৃত সঞ্জয়, আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ-সহ বেশ কয়েকজনের পলিগ্রাফ টেস্টও করেছেন তদন্তকারীরা। সূত্রের দাবি, এমনকি এবিষয়ে হাসপাতালের বিভিন্ন কর্মী ও ডাক্তারদের বয়ানেও উঠে আসছে নানারকম তথ্য। স্বভাবতই, ঘটনাস্থল সেমিনার হল কিনা, তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে তদন্তকারীদের।