শেষ আপডেট: 22nd January 2025 12:09
প্রেমিককে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে খুন করার অভিযোগে সোমবার গ্রীষ্মাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছে কেরালার আদালত। অথচ আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়কে কলকাতার আদালত দিয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এই দুই বিচারের রায় ফের যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে এ দেশে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কোনও অভিন্ন মানদণ্ড এখনও নেই।
২০২২ সালের অক্টোবর মাসে তার প্রেমিক শ্যারন রাজকে বিষ খাইয়ে খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে কেরলের গ্রীষ্মাকে ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়েছে। শ্যারন ২৩ দিন ধরে যন্ত্রণায় ভুগে মারা যান। গ্রীষ্মা এর আগে বেশ কয়েকবার শ্যারনকে বিষ খাইয়ে খুনের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সফল হয়নি।
অন্যদিকে, কলকাতার মামলায় ৩১ বছরের চিকিৎসক পড়ুয়াকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়। যা দেশে আলোড়ন ফেলে দেয়। সঞ্জয় ছিল সিভিক ভলান্টিয়ার, তাকে ওই ঘটনার পরদিনই গ্রেফতার করা হয়। পরে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত।
ভারতে বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে, ‘বিরলতম’ বলতে কী বোঝায়, তা বিচারকদের ব্যক্তিগত ব্যাখ্যার উপরই নির্ভর করে। ১৯৮০ সালে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, অপরাধ কতটা গুরুতর তা এবং অপরাধীর পরিস্থিতি বিবেচনা করে রায় দিতে হবে। কিন্তু অনেক আইনজ্ঞর মতে, এই নির্দেশিকাগুলি অস্পষ্ট থাকায় বিচারকদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য দেখা যায়।
কেরালা আদালতের যুক্তি
কেরালার আদালত গ্রীষ্মার অপরাধকে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিত খুন বলে উল্লেখ করেছে। বিচারক এ এম বাসির তাঁর রায়ে বলেছেন, গ্রীষ্মা পূর্বপরিকল্পিতভাবে শ্যারনকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছে। তার লক্ষ্য ছিল শ্যারনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া, কারণ সে অন্য একজনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছিল।
আদালত আরও জানায়, গ্রীষ্মার অপরাধ কেবল নির্মম নয়, সমাজে ভয় ও অবিশ্বাসের বার্তা ছড়িয়েছে। রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, “যুবসমাজে এটি এমন একটি বার্তা দিয়েছে যে, প্রেমিকা তার প্রেমিককে খুব সহজেই খুন করতে পারে। এটি প্রেম ও বন্ধুত্বের প্রতি আস্থা টলিয়ে দিয়েছে।”
শিয়ালদহ আদালতের যুক্তি
অন্যদিকে, শিয়ালদহ আদালত সঞ্জয় রায়কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। বিচারক অনির্বাণ দাস বলেছেন, অপরাধটি গুরুতর হলেও এটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল না। তাই এটি ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ নয়।
আদালত অপরাধীর পুনর্বাসনের সম্ভাবনা এবং পূর্ব অপরাধের রেকর্ড না থাকা বিবেচনা করে মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে যথেষ্ট শাস্তি বলে মনে করেছে।
দুই মামলায় দু’ধরণের রায় আসলে বিচারকদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যকেই স্পষ্ট করেছে বলে অনেকে মনে করেন। গ্রীষ্মার ক্ষেত্রে আদালত ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিশ্বাসঘাতকতাকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে দেখেছে। অন্যদিকে, সঞ্জয়ের ক্ষেত্রে আদালত অপরাধীর পুনর্বাসনের সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়েছে। সেই সঙ্গে জানিয়েছে এটা পূর্বপরিকল্পিত ছিল না।
এই দুই রায় ফের প্রমাণ করেছে, ভারতে মৃত্যুদণ্ড আসলে এক প্রকার লটারির মতো। যেখানে বিচারকের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক প্রভাব অনেক সময়ে রায়ের উপর বড় ভূমিকা রাখে। অবশ্য দুই ঘটনাতেই আপিলের সুযোগ রয়েছে। গ্রীষ্মা এবং সঞ্জয় দুজনেই উচ্চ আদালতে রায় চ্যালেঞ্জ করতে পারেন।
বস্তুত ভারতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার ঘটনা খুবই বিরল। ২০২০ সালে দিল্লি গণধর্ষণ মামলায় শেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল। বর্তমানে ৫৬১ জন আসামি মৃত্যুদণ্ডের রায় নিয়ে কারাগারে রয়েছেন। তবে আদালতের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে এই রায়গুলি ভারতের বিচার ব্যবস্থার অভিন্নতার অভাবকেই স্পষ্ট করছে।