সুকুমার সেন-সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: 26th January 2025 21:46
রূপক মিশ্র
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে খণ্ডে খণ্ডে ‘ভারতকোষ’ প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সম্পাদকমণ্ডলীতে রয়েছেন রমেশচন্দ্র মজুমদার, চিন্তাহরণ চক্রবর্তী, শশিভূষণ দাশগুপ্ত। কেউ দিকপাল অধ্যাপক, কেউ প্রাজ্ঞ ঐতিহাসিক, কেউ তন্নিষ্ঠ ভাষাতাত্ত্বিক। আর সভাপতির পদ অলংকৃত করেছেন যিনি, তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং ‘ভাষাচার্য’ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়৷
এই প্রকল্পের সহ-সম্পাদকদের তালিকাও নক্ষত্রখচিত—শঙ্খ ঘোষ থেকে প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য। সুবীর রায়চৌধুরী থেকে অমলেন্দু মুখোপাধ্যায়। সকলে মিলে একযোগে কোষগ্রন্থ রচনার কাজে লেগে রয়েছেন। দিবারাত্র পরিশ্রম। কখনও শব্দের ব্যুৎপত্তি নিয়ে, কখনও স্থাননাম ঘিরে, কখনও-বা কোনও ঘটনার ঐতিহাসিক ভিত্তিকে কেন্দ্র করে দেখা দিচ্ছে দ্বন্দ্ব। আর সেই ধোঁয়াশা মেটাতে অনুজ শঙ্খ ঘোষ ছুটে যাচ্ছেন সুনীতিকুমারের কাছে। প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য রমেশচন্দ্রের দ্বারস্থ হচ্ছেন। সদুত্তর মিললে এগোচ্ছে তথ্য লিপিবদ্ধ করার কাজ।
এভাবে ধীরে ধীরে গ্রন্থমালার প্রথম খণ্ড সম্পূর্ণ হল। এবার প্রকাশের পালা। সেই উপলক্ষ্যে সাহিত্য পরিষদ ভবনে বসল মোড়ক উন্মোচনের আসর। সভাপতি সুকুমার সেন। হলঘর কানায় কানায় ভরতি। উৎসুক, বিদ্বোৎসাহী মান্যগণ্য অনেকে উপস্থিত। সম্পাদকমণ্ডলী আসন গ্রহণ করেছেন।
এই অবস্থায় সভা শুরু হতে না হতেই হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার! ‘ভারতকোষ’ বিষয়ে বলতে উঠে রীতিমতো ক্ষিপ্ত সুকুমার সেন—‘এটা কাজ হয়েছে? এই বই নিয়ে আপনারা গর্ব অনুভব করছেন?’ ভূয়োদর্শী অধ্যাপক ফুঁসতে শুরু করেছেন—‘... এই সম্পাদকমণ্ডলী! আপনাদের তো লজ্জা হওয়া উচিত।’ কথা শেষ করে বইয়ের পাতা ধরে ধরে ভুল দেখাতে শুরু করলেন সুকুমারবাবু।
পাশে বসা সুনীতিকুমারের ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ অবস্থা। আমতা আমতা করে তিনি বলার চেষ্টা করলেন—‘আসলে এত বড়ো কাজ। ওরম একটু আধটু ভুলচুক থেকেই যায়! গ্রন্থশেষে একটা শুদ্ধিপত্র জুড়ে দিলেই ঝামেলা মিটে যাবে। আমাদের এই গ্রন্থ মহারাষ্ট্রের ভারতকোষ থেকে অনেক ভালো হয়েছে।’
এ কথা শুনে সুকুমারবাবুর ক্রোধ যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল—‘একটাও ভুল থাকবে কেন? যেখানে এত প্রথিতযশা অধ্যাপক সম্পাদক, সেখানে ত্রুটি রয়ে যায় কী করে?’
সুনীতিকুমারের কাছে সেই মুহূর্তে আর কোনও জবাব ছিল না। তিনি শুধু বলে গেলেন—‘... আমি আবার বলছি আমাদের কাজ মারাঠি ভারতকোষের চাইতে বহুগুণ ভালো।’
এবার রীতিমতো বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লেন সুকুমার। চোখে চোখ রেখে বলে উঠলেন—‘আপনি বারবার মহারাষ্ট্র মহারাষ্ট্র করছেন কেন? কী আছে মহারাষ্ট্রে? রয়েছেন কোনও সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ওখানে?’
দর্শকদের গুঞ্জন গেল থেমে। গোটা হল মুহূর্তে বাকস্তব্ধ। বলে চললেন সুকুমার সেন—‘... কিন্তু আমাদের তো সুনীতি চাটুয্যে আছেন। এ আমাদের গর্ব। আমরা মহারাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করব কেন?’
এতদূর পড়ে ‘দুই প্রথিতযশা অধ্যাপকের তর্ক’ বলে বিষয়টা হজম করাই যেত। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, সুকুমার সেন ছিলেন সুনীতিকুমারের সাক্ষাৎ ছাত্র। ছাত্র? শুধুই ছাত্র? নাকি ‘বিশেষ ছাত্র’? ‘অন্তরঙ্গ শিষ্য’? ‘ভাবশিষ্য’? ‘মানসপুত্র’? কোন অভিধা উপযুক্ত, সেটা পাঠকই বেছে নিন। কিন্তু দুই যুগন্ধর অধ্যাপক, ভাষাতাত্ত্বিক, মনীষীর সম্পর্কের আলেখ্য শুধুমাত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিংয়ের করিডর কিংবা সাহিত্য পরিষদের সভাঘরে আটকে ছিল না। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও এক নিবিড় অন্তরঙ্গতায় গ্রথিত ছিলেন তাঁরা। যে হৃদ্যতা তত্ত্ব ও তর্কের অলিন্দ ছেড়ে স্বচ্ছন্দ দৈনন্দিনতায় প্রসারিত হয়েছিল।
ছাত্রাবস্থায় সুকুমার সেনের ইচ্ছে তিনি বিদেশে যাবেন গবেষণা করতে। এ কথা জানতে পেরে সুনীতিকুমার তাঁর ছাত্রকে নিয়ে সটান হাজির হন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দরবারে। তুলে ধরেন তাঁর বায়োডাটা। জানান মেধাবী সুকুমারের যোগ্যতার কথা। কেন তাঁর বিদেশে যাওয়া উচিত। অধ্যাপকের তদ্বির শুনে গম্ভীর মুখে খানিক চিন্তা করেন আশুতোষ। তারপর বলেন—‘আমি আপাতত পাটনা যাচ্ছি। ফিরে এসে ব্যাপারটা নিয়ে বসা যেতে পারে।’
সে সুযোগ আসেনি আর। সেবার পাটনাতেই প্রয়াত হন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। ক্রমে বিদেশে যাওয়া নিয়েও বীতস্পৃহ হয়ে পড়েন সুকুমার। যদিও জীবনের উপান্তে পৌঁছে এই নিয়ে কোনও খেদ বা ক্ষোভ কোনওটাই ছিল না। উলটে শ্লাঘার সঙ্গে ‘সম্পূর্ণ স্বদেশি স্কলার’, কখনও-বা ‘হোম বেকড স্কলার’ বলে নিজের পরিচয় দিতেন। জানিয়েছিলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে প্রত্যক্ষ অধ্যাপক হিসেবে পাওয়ায় তাঁর পাশ্চাত্যপ্রেম উবে গেছে। কীভাবে দেশের ‘জাতীয় অধ্যাপক’ তাঁর জীবনে ‘পশ্চিমের জানলা’ হয়ে উঠেছিলেন, স্মৃতিচারণে তারও উল্লেখ করেছেন সুকুমার সেন। এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়বে সেই পশ্চিমী পণ্ডিতের কথা, যিনি বলেছিলেন—‘ভারতবর্ষ পাণিনির দেশ, আজও সেখানে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আছেন, সে দেশের ছেলেমেয়েরা ভাষাতত্ত্ব শিখতে কেন যে বিদেশে আসে তা আমি বুঝতে পারি না।’
যদিও সুনীতিকুমারকে বিনা বিচারে কোনওদিনই মেনে নেননি সুকুমার সেন। না ছাত্রাবস্থায়, না অধ্যাপক হিসেবে। সুনীতিকুমারের তৈরি করা পরীক্ষার প্রশ্নে কীভাবে ভুল ধরেছিলেন সুকুমার আর সঠিক প্রশ্নের বয়ান লিখে এসেছিলেন উত্তরপত্রে—এ তথ্য তো এতদিনে প্রবাদ। যেটা কিঞ্চিৎ আবডালে রয়ে গেছে, সেটা রামায়ণ সংক্রান্ত বিতর্ক।
১৯৭৫ সালে মহাকাব্য রামায়ণ নিয়ে অনেক নতুন ও স্বাধীন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সুনীতিকুমার। তার মধ্যে ছিল: রাম ও সীতার মধ্যে সম্পর্ক ভাই-বোনের, রামকথার সংকলক অনেকে—প্রধানত চ্যবন, সীতাহরণের কাহিনির নেপথ্যে রয়েছে গ্রিক পুরাণের প্রভাব ইত্যাদি। সুনীতিবাবুর এই মতামত স্বাভাবিকভাবে অনেক বিরুদ্ধতার জন্ম দেয়। একদিকে গোঁড়া রামভক্ত, হিন্দুত্ববাদীরা পদের মহিমা ভুলে তাঁকে আক্রমণ করে। ‘সুধর্মা’য় প্রতিদিন আসতে থাকে হুমকি-চিঠি। অধ্যাপকের প্রাণনাশ থেকে তাঁর পৌত্রকে হত্যার পরিকল্পনা—নানান কুকথা ও নাশকতায় ভরা ছিল সেই সমস্ত পত্র।
বিরোধিতার আরেকটা রব উঠেছিল বুদ্ধিজীবী মহলে। অনেকেই যুক্তি ও বিশ্লেষণের নিরিখে সুনীতিকুমারের মতকে মেনে নিতে পারেননি। তাঁদের অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন সুকুমার সেন। বিভিন্ন সাহিত্যসভায় বিতর্ক উস্কে অবশেষে পরের বছর, ১৯৭৬ সালে, সুনীতিকুমার এই নিয়ে কথা বলতে উপস্থিত হন জাতীয় গ্রন্থাগারের প্রেক্ষাগৃহে। দর্শকাসন ছয়লাপ। সাদা পুলিশ ভিড় নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই ভিড় ঠেলে কোনওমতে মঞ্চে ওঠেন সুনীতিকুমার। সভাপতি নীহাররঞ্জন রায়। আর বিবাদি-পক্ষের বক্তার একজন ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সরকার। অন্যজন সুকুমার সেন। সেদিন প্রকাশ্য সভায় তাঁর ‘গুরু’র তত্ত্ব খণ্ডন করেছিলেন সুকুমারবাবু। সুনীতিকুমারও সব মেনে নেননি। নিজের মতামত গ্রন্থাকারে লিখে যেতে চেয়েছিলেন অশীতিপর অধ্যাপক। বইয়ের পরিকল্পনাও সেরে ফেলেছিলেন। কিন্তু পরের বছরই প্রয়াত হন তিনি (২৯ মে, ১৯৭৭)। সুনীতিকুমারের আরব্ধ কাজ নিজের দর্শন ও যুক্তি মেনে শেষ করে যান সুকুমার সেন। বই লেখা চলছে আর সেটা তিনি উৎসর্গ করবেন তাঁর প্রিয়তম অধ্যাপককেই—মৃত্যুর আগে শিক্ষক সুনীতিকুমারের কানে একথা বলে যেতে পেরেছিলেন ছাত্র সুকুমার সেন। কথা রেখেছিলেন তিনি। (বইয়ের নাম: ‘রামকথার প্রাক্-ইতিহাস’। উৎসর্গপত্রে লেখা: ‘এই আলোচনার প্রবর্তয়িতা মদীয় গুরু উপাধ্যায়ী শ্রীযুক্ত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের করকমলে’।)
এই মতান্তরের উল্টোপিঠেই ছিল মৈত্রী। যা ধরা পড়ত রসিকতায়, লঘুতায়। ১৯২৪-২৫ সাল নাগাদ শান্তিনিকেতনে এসেছেন অধ্যাপক স্টেন কেনো। সেই সময় তাঁর কাছে খোটানী ধম্মপদ ও শক ভাষা শিখতে চেয়ে বোলপুর যাতায়াত শুরু করেন সুনীতিকুমার ও সুকুমার। শুক্রবার বিকেলে যান। রবিবার বিকেল কিংবা সোমবার সকালে ফিরে আসেন। এই যাতায়াতের পথে কোনও একদিন সুকুমার সেন সুনীতিকুমারের থেকে এক টাকা ধার করেছিলেন। তারপর সেটা ফেরৎ দেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে যান। দিন যায়, মাস যায়। লজ্জার মাথা খেয়ে টাকা চাওয়ার কথাটুকু সুনীতিকুমারের আর বলা হয়ে ওঠে না। শেষে একদিন নিজেই মোক্ষম উপায়টি আবিষ্কার করেন। লোকাল ট্রেনে ফিরে আসার সময় সুকুমার সেন যখন বর্ধমানে নেমে যাব যাব করছেন, তখন সুনীতিকুমার বলে বসেন—‘অএবম্ এরেজতম্ দজদী’। আবেস্তীয় ভাষা। যার সরল বাংলা অর্থ: ‘একটি টাকা দাও’। কথা শোনামাত্র লজ্জায় জিভ কেটে পকেট থেকে টাকা বের করে অধ্যাপকের হাতে তুলে দেন সুকুমারবাবু।
সুনীতিকুমার অন্য সব বিষয়ে সহিষ্ণু হলেও আধুনিক বাংলা কবিতা সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর মতে, বাংলা কবিতার সোনালি যুগ রবীন্দ্রনাথেই শেষ৷ তাঁর উত্তরসূরীদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ ও নজরুল কবিতা লিখতে জানতেন। বাকি সকলেই ব্যর্থ। সুকুমার সেন আবার নব্য যুগের পন্থী৷ আকছার এই নিয়ে দুজনের মধ্যে মধুর বিতর্ক হত।
একদিন সুকুমার সেন ছেলে সুভদ্রকুমারের হাত দিয়ে কয়েকটি বই সুনীতিবাবুর বাসায় পাঠান। সেই তালিকায় বুদ্ধদেব বসু, সমর সেন, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে সকলে ছিলেন। সুনীতিকুমার জানান, পড়তে দিন পনেরো সময় লাগবে৷ তারপর তিনি বইগুলো ফেরৎ দেবেন। পনেরো দিন বাদেই ‘সুধর্মা'য় হাজির হন সুভদ্রকুমার। আর বইগুলো সুকুমার-পুত্রের হাতে দিয়ে সুনীতিকুমার বলেন—‘বাবাকে গিয়ে জানিও, সবকটাই আমি পড়েছি, কিন্তু কিছু বুঝিনি। বাবাকে বলবে, হয় আমি মহামূর্খ, কিছুই বুঝতে পারি না আর নয়তো উনি মহামূর্খ, কিছুই বুঝতে পারেন না। একে কি কবিতা বলে?’
এই সূক্ষ্ম রসিকতা ও পরিচ্ছন্ন পরিহাস তো বাইরের আবরণ মাত্র। দুজনের মধ্যে আন্তরিক শ্রদ্ধার বাঁধনটি চিরকাল অটুট ছিল। ছাত্র হলেও জীবনে কোনওদিন সুকুমার সেনকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেননি সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। সবসময় নামের শেষে ‘বাবু’ এবং ‘আপনি’ জুড়ে থাকত। অধ্যাপক হয়ে একইভাবে নিজের ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলতেন সুকুমার সেনও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গুরু’র ছেড়ে যাওয়া আসনও তিনিই অলংকৃত করেন (ভাষাতত্ত্ব বিভাগের দ্বিতীয় খয়রা অধ্যাপক)। সুনীতিকুমারের মৃত্যুর পর তাঁর অতলান্ত মেধা ও গগনচুম্বী পাণ্ডিত্যের কথা বলতে গিয়ে সুকুমার সেন লিখেছিলেন—‘উচ্চতা অনেক রকমের হয়। অট্টালিকাও উচ্চ, আবার মহীরুহও উচ্চ। একটি নিষ্প্রাণ, অন্যটি জীবনরসে সমৃদ্ধ। সুনীতিবাবুর ছিল সেই বনস্পতির উচ্চতা।’
তথ্যঋণ:
১. শঙ্খ ঘোষ: ‘ছেঁড়া ক্যাম্বিসের ব্যাগ’
২. সুকুমার সেন: ‘দিনের পরে দিন যে গেল’
৩. অনুনয় চট্টোপাধ্যায়: ‘সুনীতিকুমার’