গর্ভাবস্থায় স্তন ক্যানসার।
শেষ আপডেট: 4th February 2025 11:37
দ্য ওয়াল ব্যুরো: প্রথম সন্তান জন্মের দু'বছর পরে ফের গর্ভবতী হয়েছিলেন মিজোরামের এক ৩৮ বছর বয়সি মহিলা, সুমতি (নাম পরিবর্তিত)। কিন্তু তার পরেই লক্ষ করেন, বাম স্তনে একটি চাকার মতো দাগ। প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও, দাগটি দ্রুত বেড়ে উঠতে থাকলে, তা নিয়ে চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হন তিনি। বিস্তর সমস্যা পার করে ধরা পড়ে, স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত তিনি (Pregnancy Associated Breast Cancer)। গর্ভাবস্থাতেই সেই ক্যানসারের চিকিৎসা করা হয়। সময়মতো সুস্থভাবে কন্যাসন্তানের জন্মও দেন তিনি। কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালের সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট ডক্টর শুভদীপ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় এই গোটা পর্ব। আজ, ৪ ফেব্রুয়ারি, বিশ্ব ক্যানসার সচেতনতা দিবসে (World Cancer Day) জেনে নেওয়া যাক সেই অভিজ্ঞতার কথা।
গর্ভাবস্থার প্রথম থেকেই একের পর এক সমস্যার মুখে পড়েন সুমতি। প্রাথমিকভাবে স্তনের দাগটি বাড়তে থাকার পরে, স্থানীয়ভাবে মিজোরামে ডাক্তার দেখিয়েছিলেন তিনি। আইজলের চিকিৎসকরা তাঁকে ট্রু কাট বায়োপসি পরীক্ষার পরামর্শ দেন। সেইমতো পরীক্ষাও করান তিনি। তবে সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে তাঁকে জানানো হয়, স্তনে ‘টিউবুলার অ্যাডেনোমা’ হয়েছে। এটি সাধারণত ক্ষতিকর নয়, চিকিৎসায় সেরে যায়।
কিন্তু গর্ভাবস্থা যত এগোতে থাকে, সেই সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্তনের চাকার মতো দাগটিও আরও বড় হতে থাকে, যা সন্দেহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর পরে আর দেরি না করে, কলকাতায় এসে প্রফেসর ডক্টর শুভদীপ চক্রবর্তীর কাছে যান সুমতি।
ডক্টর চক্রবর্তী জানান, তখন ১৭ সপ্তাহ চলছে সুমতির। পরীক্ষানিরীক্ষার পরে দেখা যায়, তাঁর বাঁ স্তনে ৭×৫ সেন্টিমিটার এবং বাঁ কাঁধের নিচে ২×৩ সেন্টিমিটার মাপের চাকা রয়েছে। নতুন করে ট্রু কাট বায়োপসি পরীক্ষায় ধরা পড়ে, এটি ট্রিপল নেগেটিভ ইনভেসিভ কার্সিনোমা। অর্থাৎ বেশ খারাপ ভাবে ছড়িয়ে পড়া ক্যানসার।
রোগীর অনুরোধ ছিল, তিনি কোনওভাবেই গর্ভপাত করতে চান না। এরপর, নন-কন্ট্রাস্ট এমআরআই করা হয়, যা দেখায় যে ক্যানসার এখনও শরীরের অন্য কোথাও ছড়ায়নি। আরও রিসার্চ করে দেখা হয়, তাঁর পরিবারে স্তন বা ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের কোনও ইতিহাস নেই। অর্থাৎ খানিকটা হলেও ঝুঁকি কম।
এর পরেই শুরু হয় চিকিৎসা। অ্যাপোলো মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতালের একটি বিশেষজ্ঞ বোর্ড গঠন করা হয়, তাতে ছিলেন, প্রফেসর ডক্টর শুভদীপ চক্রবর্তী (সার্জিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট), ডা. তাপস কর (সার্জিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট) ডা. পিএন মহাপাত্র (পরিচালক, মেডিক্যাল অঙ্কোলজি বিভাগ), ডা. রমনা ব্যানার্জী (প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ)।
শুরু হয় কেমোথেরাপি। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব গর্ভস্থ সন্তানের ওপর পড়তে পারে, একথা রোগীকেও বোঝানো হয়। এরপর তাঁকে চারটি করে দু'দফায়, মোট ৮টি সাইকেল নিউ অ্যাডজুভান্ট কেমোথেরাপি দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়।
রোগী কলকাতায় থেকেই চিকিৎসা চালিয়ে যান। সপ্তম কেমোথেরাপির পরে যখন তাঁর গর্ভাবস্থা পৌঁছয় ৩৪ সপ্তাহ ৫ দিনে, সে সময়েই সিজার করার সিদ্ধান্ত নেন গাইনি চিকিৎসক। এক সুস্থ কন্যাসন্তানের জন্ম দেন সুমতি, তার ওজন ছিল ২.৮ কেজি। এরপর তিনি অষ্টম কেমোথেরাপিও সম্পন্ন করেন সদ্যোজাতকে নিয়েই।
কেমোথেরাপি শে। হওয়ার তিন সপ্তাহ পরে, তিনি ক্যানসার আক্রান্ত স্তনের সার্জারি অর্থাৎ ম্যাস্টেকটমিও করান। বাদ দেওয়া হয় ৩৮টি লিম্ফনোডও। সবকটিতেই ছড়িয়ে পড়েছিল ক্যানসার।
চিকিৎসকরা জানান, সার্জারির পরে খাতায়-কলমে সুমতি পুরোপুরি 'ক্যানসার-মুক্ত' হয়ে গেলেও, আগামীদিনের সুরক্ষার কথা ভেবে তাঁকে অন্য স্তন এবং ওভারি দুটিও সার্জারি করে বাদ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে তিনি তাতে রাজি হননি। তার বদলে সমস্ত নিয়ম মেনে থাকবেন এবং নিয়মিত ফলোআপ করবেন বলে জানান। বর্তমানে তিনি অ্যাডজুভান্ট রেডিয়েশন থেরাপি নিচ্ছেন, কনসালট্যান্ট রেডিয়েশন অঙ্কোলজিস্ট ডক্টর শান্তনু আচার্যর তত্ত্বাবধানে।
চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, প্রেগন্যান্সি অ্যাসোসিয়েটেড ব্রেস্ট ক্যানসার (PABC) হল এমন এক স্তন ক্যানসার, যা গর্ভাবস্থা, স্তন্যপানকালীন, বা সন্তান জন্মের এক বছরের মধ্যে ধরা পড়ে। প্রতি ১ লক্ষ সন্তান জন্মের সময়ে ৪০ জন মায়ের এই ক্যানসার হতে পারে। গর্ভধারণের পরে এই ক্যানসারের ঝুঁকি স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি। এটি সফলভাবে চিকিৎসার জন্য একটি বহুমুখী চিকিৎসা পরিষেবা দরকার।
ক্যানসার শব্দের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে নানাবিধ আশঙ্কা ও হতাশা। তার উপর তা যদি গর্ভকালীন পরিস্থিতিতে শরীরে বাসা বাঁধে, তাহলে তা আরওই ঝুঁকির হয়ে ওঠে। তবে সুমতির ঘটনা প্রমাণ করে, সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নিলে, গর্ভাবস্থাতেও স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা সম্ভব। কেমোথেরাপির নিরাপদ ও পরিকল্পিত প্রয়োগ, গর্ভধারণের সতর্ক নজরদারি এবং সদ্যজাত শিশুর জন্য উন্নত নবজাতক পরিষেবা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যাপোলো মাল্টিস্পেশ্যালিটি হসপিটালে সে সবকিছু ছিল বলেই এক মায়ের সাহস এবং একদল চিকিৎসকের সফল প্রচেষ্টার ফলে নির্মিত হয়েছে এক অনন্য সাফল্যের কাহিনি।