ডক্টর শুভদীপ চক্রবর্তী ও ডক্টর তাপস কর।
শেষ আপডেট: 8th April 2025 11:12
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ২৬ বছর ধরে মুখের একপাশে বয়ে চলেছিলেন এক বিশাল টিউমার। ধীরে ধীরে তা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে মুখের গঠনই বিকৃত হয়ে যায়। নানা রোগে জর্জরিত এই বৃদ্ধাকে প্রায় সব হাসপাতালেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অবশেষে দক্ষিণ কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে একদল চিকিৎসকের সম্মিলিত সাহসে ও সুনিপুণ পরিকল্পনায় সফল অস্ত্রোপচারে অপসারণ করা হল সেই টিউমার। নতুন জীবন ফিরে পেলেন মুর্শিদাবাদের ৬৯ বছরের ওয়ালিমা বেগম।
মুখে বাঁ পাশে ছোট্ট একটি গাঁট দিয়েই শুরু হয়েছিল সবকিছু। সেটাই ধীরে ধীরে বিশাল আকার নেয়। গত পাঁচ মাসে হঠাৎ করেই টিউমারটি দ্রুত বাড়তে থাকে। খাওয়া-দাওয়া, কথা বলা, এমনকি দৈনন্দিন জীবনযাপনেও দেখা দেয় অসুবিধা।
তার উপর ডায়াবেটিস, দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্টজনিত রোগ (COPD), ক্রনিক কিডনি ডিজিজ, রক্তশূন্যতা—সব মিলিয়ে একাধিক জটিলতা ছিল ওয়ালিমা বেগমের। তাই কলকাতার একাধিক ক্যানসার সেন্টার এত বড় ও জটিল অস্ত্রোপচার করতে অস্বীকার করে।
শেষমেশ ওয়ালিমার পরিবার পৌঁছোন অ্যাপোলো ক্লিনিক, মুকুন্দপুরে। এখানে অধ্যাপক (ডাঃ) শুভদীপ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে রোগীর সমস্ত শারীরিক অবস্থার পরীক্ষা হয়। FNAC রিপোর্টে জানা যায়, এটি একটি Pleomorphic Adenoma—অর্থাৎ গ্রন্থিজাত, কিন্তু নন-ম্যালিগন্যান্ট টিউমার।
নন-কনট্রাস্ট এমআরআই-তে ধরা পড়ে, মুখের ডান পাশে ১৪ সেন্টিমিটারেরও বেশি বড় একটি টিউমার রয়েছে, যা মাসেটার মাসল পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। এই জটিল পরিস্থিতিতে গঠন করা হয় একটি বিশেষ মেডিক্যাল বোর্ড। তাতে ছিলেন:
ডাঃ শুভদীপ চক্রবর্তী (সার্জিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট)
ডাঃ তাপস কর (সার্জিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট)
ডাঃ শিবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় (সিনিয়র মেডিসিন বিশেষজ্ঞ)
ডাঃ তীর্থঙ্কর চৌধুরী (এন্ডোক্রিনোলজিস্ট)
ডাঃ নবারুণ রায় (কার্ডিওলজিস্ট)
ডাঃ দেবোপম চট্টোপাধ্যায় (পালমোনোলজিস্ট)
ডাঃ বিবেক গয়াল (নেফ্রোলজিস্ট)
ডাঃ সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য (প্লাস্টিক সার্জন)
রোগী ও তাঁর পরিবারকে ঝুঁকির কথা জানিয়ে অনুমতি নেওয়ার পর অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত হয়। প্রায় ৫ ঘণ্টা ধরে চলে অপারেশন। ডাঃ শুভদীপ চক্রবর্তী ও ডাঃ তাপস কর নেতৃত্ব দেন অস্ত্রোপচারে। ব্যবহার হয় Intraoperative Nerve Monitoring প্রযুক্তি— যার ফলে রক্ষা করা সম্ভব হয় মুখের ডান পাশের নার্ভও।
এই অপারেশনে টিউমার-সহ আশপাশের ত্বক কেটে ফেলা হয়। সব মিলিয়ে বাদ যাওয়া মাংসপিণ্ডের ওজন ছিল ১ কেজি ৫৪৫ গ্রাম। পরে প্লাস্টিক সার্জন ডাঃ সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য গলার ত্বক ব্যবহার করে প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে ঢেকে দেন সেই জায়গা। অপারেশনের সময় টিউমারের নমুনা পরীক্ষা করে কোনও ক্যানসার কোষ পাওয়া যায়নি।
অস্ত্রোপচারের মাত্র পাঁচদিন পরেই ওয়ালিমা বেগমকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এখন তিনি স্বাভাবিকভাবে কথা বলছেন, খাচ্ছেন এবং জীবনযাত্রা আগের মতোই চালিয়ে যাচ্ছেন।
চিকিৎসকদের মতে, রোগীর এত দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা থাকা সত্ত্বেও এই জটিল অপারেশনের সফলতা একটি বিরল দৃষ্টান্ত। টিমওয়ার্ক, পরিকল্পনা এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারই এই সাফল্যের চাবিকাঠি।