রেমালের দাপটে শুনশান কলকাতার রাজপথ, পড়ে রয়েছে গাছ।
শেষ আপডেট: 27th May 2024 15:01
দ্য ওয়াল ব্যুরো: আজ কলকাতায় লালমোহনবাবু থাকলে জটায়ুর উপন্যাসের প্রেক্ষাপট খুঁজতে আর তাঁকে সাহারা, হন্ডুরাস করতে হত না! গড়পার থেকে সবুজ অ্যাম্বাস্যাডর নিয়ে বেরোলে সপ্তাহের প্রথম দিনে শহর কলকাতাতেই দেদার উপাদান পেতেন।
গতকাল মাঝরাতে বাংলাদেশের মংলা উপকূলে আছড়ে পড়েছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। তার ঝাপটায় সারারাত কার্যত তাণ্ডব চলেছে কলকাতায়। সোমবার, সপ্তাহের প্রথম কাজের দিনেও শহরকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ল রেমাল। উত্তর থেকে দক্ষিণ, সপ্তাহের প্রথম কাজের দিনে এ'হেন দুর্যোগে প্রায় ছুটির মেজাজে মহানগর।
দিনের আলো ফোটার পর থেকেই বেলা কত গড়াল, আর বোঝার উপায় নেই। সকাল থেকে দফায় দফায় বৃষ্টি, সঙ্গে তীব্র ঝোড়ো হাওয়া। রাতভর ঝড় আর বৃষ্টিতে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় গাছ পড়ে রাস্তা অবরুদ্ধ। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ শুরু করেছে কলকাতা পুরসভা। মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, সম্পূর্ণ লোকবল নিয়েই কাজে নেমেছেন পুরকর্মীরা।
সকাল সাড়ে এগারোটায় পাতিপুকুর আন্ডারপাসে দেখা গেল, রাস্তা বন্ধ। ততক্ষণে বৃষ্টির দাপট খানিক ধরেছে। শুধু বেসামাল করে দিচ্ছে ঝোড়ো হাওয়া। দীর্ঘদিন ধরেই জল জমার জন্য কুখ্যাত পাতিপুকুর আন্ডারপাস। সংস্কার করে নতুন আন্ডারপাস বানানো হলেও বড় আকারের ঝড়বৃষ্টিতে প্রায়শই কোমরজল হয়ে যায় এখানে। দক্ষিণ দমদম পুরসভা তাই কোনও ঝুঁকিতে যায়নি। সকাল থেকে দফায় দফায় পাম্প চলছে। জল অনেকটাই কম। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে রাস্তা বন্ধই রেখেছে বিধাননগর পুলিশ। একদিক দিয়ে যাতায়াত চলছে।
সপ্তাহের কাজের দিনে অনেকেই ভেবেছিলেন, ঝড় এড়াতে মেট্রোয় সওয়ার হবেন। মাটির তলায় হয়ত রেমালের থাবা গিয়ে পৌঁছবে না। কিন্তু বিধি বাম। সবচেয়ে ভরসার জায়গা মেট্রোই রিমেলের দাপটে ডাহা ফেল। পার্ক স্ট্রিট স্টেশনের দেওয়াল চুঁইয়ে টাইলসের ফাঁক গলে ফোয়ারার মত জল ঢুকে এসেছে ভেতরের প্যাসেজে। পার্ক স্ট্রিট স্টেশন এমনিতে কলকাতা মেট্রোয় মাটির গভীরতর জায়গায়। কবি সুভাষগামী প্ল্যাটফর্ম থেকে দক্ষিণেশ্বর-গামী প্ল্যাটফর্মে আসতে লাইনের তলা দিয়ে আন্ডারপাস রয়েছে। কিন্তু বেলা গড়াতেই দেখা যায়, রাতভর বৃষ্টিতে ওপরের ময়দানের নিকাশিব্যবস্থা কাজে ইস্তফা দিয়েছে। ফলে জল নেমে এসেছে মেট্রোর সুড়ঙ্গে। কিন্তু কী করে কংক্রিটের আস্তরণ ভেদ করে জল মেট্রোর দ্বিস্তরীয় আবরণ চিরে ঢুকে পড়ল প্ল্যাটফর্মে, তার সদুত্তর দিতে পারছেন না কেউই। মেট্রোর মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক কৌশিক মিত্র যেমন বলেছেন, জল জমে যাওয়ায় তাঁরা আর ঝুঁকি নিতে চাননি। পরিষেবা বন্ধ রেখেছিলেন। অতএব সকালে মেট্রো চলছিল কবি সুভাষ থেকে ময়দান, উত্তরে দক্ষিণেশ্বর থেকে গিরিশ পার্ক অবধি। দুপুর সওয়া বারোটায় মেট্রো চলাচল স্বাভাবিক হয়।
বেলা সাড়ে বারোটায় পার্ক স্ট্রিট স্টেশনে নামতেই চোখে পড়ল, তখনও বানভাসি অবস্থার ছাপ রয়েছে। দফায় দফায় জল বের করার কাজ চালাচ্ছেন মেট্রোকর্মীরা। যাত্রীরা শান বাঁধানো মেঝেয় সাবধানে পা ফেলে হাঁটছেন। রীতিমত পিছল অবস্থা। এক নিত্যযাত্রী অস্ফুটে বলে গেলেন, 'স্টেশনের দেওয়াল ফেটে জল বেরোচ্ছে, এমনটা শেষ কবে দেখেছি মনে করতে পারছি না।'
দুপুর একটায় রাসবিহারী মোড়ে আবার অন্য ঝঞ্ঝাট! গড়িয়াহাটের দিকে লম্বা যানজট। সার দিয়ে দাঁড়িয়ে বাস-অটো-গাড়ি। আকাশ তখন আরও কালো করে এসেছে। বৃষ্টির তোড় বাড়ছে, ঝড়ে গাছগুলো প্রায় উথাল-পাথাল করছে। খানিক এগিয়ে দেখা গেল, লেক মার্কেটের উল্টোদিকে গাছ পড়েছে রাস্তায়। ক্রেন নিয়ে এসে সাফাই করছেন পুরকর্মীরা। এসেছে পুলিশ। দ্রুত অবশ্য একটা পাশ সাফ করে গাড়ি যাওয়ার রাস্তা করে দিলেন পুরকর্মীরা। দেশপ্রিয় পার্কের সামনে শরৎ বসু রোডের মোড়ে ব্যস্ত সময়ে রাজপথ প্রায় শুনশান। গড়িয়াহাটের মোড়ে চেনা ভিড়ের লেশমাত্র নেই। দুপুর দেড়টায় কসবা থানার সামনে আবারও বন্ধ রাস্তা। একেবারে থানার বাইরেই প্রকাণ্ড গাছ পড়ে রয়েছে! রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের রুবি-মুখী লেন পুরোপুরি বন্ধ। গড়িয়াহাট-মুখী লেন দিয়েই দু'দিকের যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে পুলিশ।
খাতায় কলমে অনেকটাই দুর্বল হয়েছে রেমাল। মৌসম ভবন জানিয়েছে, আজ ভোর সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই শক্তি হারিয়ে প্রবল থেকে সাধারণ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে রেমাল। এখন এটির অবস্থান স্থলভাগের ওপরেই, মংলা বন্দরের ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। অর্থাৎ, ঘূর্ণিঝড়ের শক্তিকেন্দ্র বা 'চোখ'-কে হিসেবে রাখলে, এই মুহূর্তে রেমাল রয়েছে কলকাতার ৯০ কিলোমিটার পুবে। আজ বিকেলের মধ্যেই এটি আরও শক্তি হারিয়ে গভীর নিম্নচাপে নেমে আসবে। কিন্তু এখনও তার রোষে থরহরি কম্পমান কলকাতার। জায়গায় জায়গায় গাছ পড়েছে, বিদ্যুতের তার ছিঁড়েছে, ইন্টারনেট পরিষেবাও ব্যহত। কিন্তু তারপরেও, নেহাত এই আবহে অনেকেই বাড়ি ছেড়ে বেরোতে চাননি, ফলে সেই অর্থে রাস্তায় গাড়িঘোড়ার সংখ্যা কম। সপ্তাহের প্রথম কাজের দিনে তাই দেদার গাছ পড়লেও বড় রকমের যানজট এড়াতে পেরেছে শহর।