শেষ আপডেট: 23rd February 2024 18:04
দ্য ওয়াল ব্যুরো: সেই ব্রিটিশ আমল। পুরনো কেল্লা রক্ষা করা আর সিরাজের বাহিনীকে বাধা দিতে ইংরেজরা তিন জায়গায় কামান সাজিয়েছিল, যাকে সামরিক পরিভাষায় বলে ‘ব্যাটারি অব গানস’। এখনকার হাওড়া ব্রিজের কাছে ‘নর্থ ব্যাটারি’, লালবাজারের কাছে ‘ইস্ট ব্যাটারি’ আর রাজভবনের জায়গায় ‘সাউথ ব্যাটারি’। যুদ্ধের দিন ফুরিয়েছে, ব্রিটিশরাও দেশ ছেড়েছে। নবাবি আমলও আর নেই। কিন্তু সে যুগের স্মৃতি আঁকড়ে মাথা তুলে এখনও শ্বাস নিচ্ছে প্রাচীন কিছু কামান। কখনও ফেয়ারলি প্লেস আর স্ট্র্যান্ড রোডের মোড়ে ফুটপাতে, কখনও দমদমের সেন্ট্রাল জেল মোড় এলাকায় নবাবি আমলের কামান উদ্ধার হয়েছে। আর এবার ক্যামাক স্ট্রিটে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রাচীন কামানের খোঁজ পাওয়া গেল।
রাজ পরিবারের কামান এতদিন নজরের আড়ালেই ছিল। রাস্তার ধারে বহুবছর ধরে কামানের সামনের অংশটা মাথা উঁচু করে ছিল। তবে তা পথচারীরা ধর্তব্যের মধ্যে ফেলেননি। সেটি যে কামান তাও বোধগম্য হয়নি। রাজ্যের অ্যাডমিনিস্ট্রের জেনারেল অ্যান্ড অফিসিয়াল ট্রাস্টি (এজিওটি) বিপ্লব রায়ের চোখে প্রথম পড়ে সেটি। বিপ্লববাবু বলছেন, রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় চোখটা সেদিকে পড়ে। রাস্তা থেকে মাথা তুলে আড়ালেই ছিল সেটি। বিপ্লববাবু জহুরির চোখ দিয়ে চিনে নেন আসল রতন। সেটি বের করা হয় মাটি খুঁড়ে। ডাক পড়ে প্রত্নতত্ত্ববিদদের। মাটি খুঁড়তেই চোখ কপালে ওঠে সকলের। এতদিন যেটিকে হেলাফেলা করা হচ্ছিল, সেটি আসলে বিশালাকার একটি কামান। তার মুখে আবার আটকানো রয়েছে গোলা।
বিপ্লববাবু বলেন, মাটিতে আধখানা পোঁতা অবস্থায় আকাশের দিকে মুখ তুলে ছিল কামানটি। এমনিতে কামানের পিঠে নির্মাণের সাল এবং তারিখ খোদাই করা থাকে। এছাড়াও বহু সাংকেতিক চিহ্ন থাকে, যা দেখে কামানের ইতিহাস জানা যায়। তবে দীর্ঘদিন রাস্তার ধারে অবহেলায় পড়ে থাকায় সেটির গায়ে ধুলোবালি, মাটি জমে ছিল। বিপ্লববাবু বলছেন, কামানটির ইতিহাস জানতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে মনে করা হচ্ছে, কামানটি ঊনবিংশ শতকের। কোনও রাজ পরিবারে সেটি ব্যবহৃত হত।
এই কামানটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৬ ফুট। ৭ নম্বর ক্যামাক স্ট্রিটের একটি বাড়ির বাইরে থেকে কামানটি উদ্ধার হয়েছে। বিপ্লববাবুরা মনে করছেন, কামানটি স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের হতে পারে। ভারতের যশস্বী বাঙালি শিল্পপতি ও সুদক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন স্যার রাজেন্দ্রনাথ। রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার ভ্যাবলা গ্রামের এক সাধারণ গৃহস্থর পরিবারে। ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন রাজেন্দ্রনাথ। অ্যাকুইন মার্টিন ও রাজেন্দ্রনাথ মিলে তৈরি করেছিলেন মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি। ব্রিটিশ স্থপতি উইলিয়াম এমারসনের ডিজাইনে মহানগরীর গর্ব ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তৈরি হয়েছিল তাঁরই তত্ত্বাবধানে। রাজভবনের বিপরীতে এসপ্লানেড ম্যানসন, মহীশূর প্যালেস ইত্যাদি নির্মিত হয়েছিল রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানেই। বর্তমান হাওড়া ব্রিজ তথা রবীন্দ্র সেতু নির্মাণে ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে যে বিশেষজ্ঞ কমিটি সে সময়ে গঠিত হয়েছিল তার সভাপতি হিসাবে লন্ডনে গিয়েছিলেন স্যার রাজেন্দ্রনাথ। ব্রিজ তৈরির প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর তত্ত্বাবধানেই ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে বেলুড় মঠে রামকৃষ্ণ মন্দির স্থাপিত হয়েছিল।
বিপ্লববাবু বলেন, নতুন যে স্টেট জুডিশিয়াল মিউজিয়াম অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার তৈরি হচ্ছে, সেখানে এই কামানটি প্রদর্শিত হবে। আগে কলকাতায় মুঘল আমলের কামান, ব্রিটিশদের ব্যবহার করা কামান উদ্ধার হয়েছে। ফেয়ারলি প্লেসে যে কামানটি উদ্ধার হয়েছে সেটি ইংল্যান্ডে ১৭৩২ সালে তৈরি হত। ১৮ পাউন্ড ওজনের গোলা ছোড়া যেত সেটি থেকে। ক্যামাক স্ট্রিটের কামানটি ঢালাই লোহার তৈরি। এই কামান কোনও রাজ পরিবারের বলেই অনুমান। অতীতে রাজা-মহারাজারা এই ধরনের কামান ব্যবহার করতেন। এতে ন’পাউন্ডের গোলা ব্যবহৃত হত।