Advertisement
প্রিয়রঞ্জন-সোমেন-দিলীপ (গ্রাফিক্স- শুভম সেনগুপ্ত)
Advertisement
শেষ আপডেট: 20 April 2025 10:18
’৯৪ সালে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ ছিল না। ২ বৈশাখ সকালে খবরের কাগজ পড়ে যখন জানা গেল, নববর্ষের সন্ধেয় বিয়ে করেছেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি (Priya Ranjan Dasmunsi), তা ছিল গরম কচুরির মতোই। মুচমুচে ও খাস্তা। কংগ্রেসি রাজনীতিতে দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা ছিলেন প্রিয়রঞ্জন। যিনি চিরকুমার থেকে যাবেন বলে সুব্রত মুখোপাধ্যায়-সোমেন মিত্ররাও ধরে নিয়েছিলেন। সেই তিনি—'প্রিয় দা’ ৫০ বছর বয়সে পৌঁছে যে বিয়ে করতে পারেন, অনেকের কাছেই ছিল কল্পনারও অতীত। ঠিক যেমন, দিলীপ ঘোষের (Dilip Ghosh Marriage) ব্যাপারেও ঘটছে।
কিন্তু এই ছবিটা নিতান্তই ছোট। ক্ষুদ্র আয়নায় দেখা। বর্তমান তথা তাৎক্ষণিকতার এই সময়ে এমনটা হওয়াই দস্তুর। তবে বড় ছবিটা যদি কেউ দেখতে চান, তবে দেখতে পাবেন গড়ের মাঠ পড়ে রয়েছে। সেই মাঠে প্রিয়রঞ্জন, সোমেন মিত্র, দিলীপ ঘোষরা একই পংক্তিতে দাঁড়িয়ে। রাজনৈতিক জীবনে তাঁদের চরম খরার সময়েই চিত্রনাট্যে প্রবেশ ঘটেছে দীপা-শিখা-রিঙ্কুদের।
এ পথে প্রিয়রঞ্জনই প্রথম পথিক। দীপা দাশমুন্সির সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় ১৯৯৪ সালে। বাংলা ক্যালেন্ডার ধরলে সেটা ১ বৈশাখ। প্রিয়রঞ্জনের রাজনৈতিক জীবনে সে যেন বড় হতাশার প্রহর। অথচ ১৯৮৯ সালেও প্রিয়রঞ্জন জাতীয় রাজনীতিতে গনগন করছেন। মাত্র ৪৪ বছর বয়স। রাজীব গান্ধীর মন্ত্রিসভায় সেই সময়েই কেন্দ্রে বাণিজ্য মন্ত্রী। আবার পশ্চিমবঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি।
কিন্তু ৮৯ সালে লোকসভা ভোটে হাওড়া আসনে হেরে যান প্রিয়রঞ্জন। সিপিএম প্রার্থী সুশান্ত চক্রবর্তী হারিয়ে দেন প্রিয়রঞ্জনকে। ৮৯ সালের পর ৯১ সালে ফের লোকসভার ভোট হয়। সেই ভোটেও হাওড়া লোকসভা আসনে প্রার্থী হন প্রিয়। কিন্তু সেই ভোটেও ডাহা হারেন তিনি। প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি পদও চলে যায় তাঁর। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, কংগ্রেসে প্রিয়র অনুগামীরা একে একে শিবির বদল করে ফেলেন। যেন কাক, চিলও বসে না তাঁর বাড়ির পাঁচিলে। ঠিক এমনই পরিসরে দীপা দাশমুন্সির সঙ্গে প্রেম সম্পর্কের শুরু প্রিয়। রাজনৈতিক জীবনে তাঁর চরম হতাশার মুহূর্তে আশ্রয় নেন দীপার কাছে। পরে বিয়েও করেন দীপাকে।
সোমেন মিত্র জীবনগাঁথাও এ ভিন্ন নয়। নয়ের দশকের গোড়াতেও কলকাতায় কংগ্রেসি রাজনীতিতে সোমেন মিত্রর প্রভাব ও প্রতাপ দুটিই ছিল। সোমেন দা তখন কংগ্রেসের তরুণ প্রজন্মের কাছে আইকন। দলের অনেক কর্মী তখন তাঁকে নকল করে চুলে টেরি পাকান, পায়ে সাদা স্যান্ডেল পরেন। কিন্তু ৯৬ সাল নাগাদ পালা বদল ঘটতে শুরু করে দেয়। সোমেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পদে থাকলেও কংগ্রেসের গরিষ্ঠ সংখ্যক নেতা-কর্মী চলে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে। ৯৭ সালে সেই ছবি আরও প্রকট হয়ে পড়ে। প্রদীপ ভট্টাচার্য-বাদল ভট্টাচার্যের মতো গুটিকয় নেতা ছাড়া সোমেনের সঙ্গে তখন আর তেমন কেউ নেই। হতাশা গ্রাস করতে থাকে ৪৫ নম্বর আমহার্স্ট স্ট্রিটের ‘ছোড়দাকে’।
এ ঘটনার অনেক আগে থেকেই শিখা সাহার (সোমেনকে বিয়ে করার পর শিখা মিত্র হন) সঙ্গে সোমেনের সখ্য ছিল। শিয়ালদহ এলাকারই এক কংগ্রেস নেতার মেয়ে ছিলেন শিখা। তবে সেই সম্পর্কে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়ার কথা সোমেনেরও প্রথম মনে হয় ওই ৯৭ সালে। যখন তিনি অনেকটাই নিঃসঙ্গ ও হতাশ।
একটু নজর করলে দেখা যাবে দিলীপ ঘোষের জীবনেও রিঙ্কু মজুমদারের আবির্ভাব ঘটে ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটের পর। ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটের আগে রাজ্য বিজেপির সভাপতি হন দিলীপ। তিনিই প্রথম বিধানসভায় বিজেপির খাতা খোলেন। তার পর তিনি সভাপতি পদে থাকাকালীন ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে বাংলায় ১৯টি আসনে জেতে বিজেপি। সে ছিল, এখনও পর্যন্ত দিলীপ ঘোষের রাজনৈতিক কেরিয়ারে সর্বোচ্চ বিন্দু। কিন্তু ২০২১ সালে বিজেপি মাত্র ৭৭টি আসনে আটকে যাওয়ার পর থেকেই দলের মধ্যে ক্রমশ কোণঠাসা হতে থাকেন। রাজ্য বিজেপির সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। দিলীপ ঘোষ ও তাঁর অনুগামীদের সরিয়ে রাজ্য বিজেপির রাশ চলে যায় শুভেন্দু-সুকান্তদের হাতে।
দিলীপ ঘোষের স্ত্রী রিঙ্কুই জানিয়েছেন, একুশ সালে বিধানসভা ভোটের পরই দিলীপ ঘোষের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তার পর থেকে সময় কাটতে থাকে। দিলীপের রাজনৈতিক জীবনে আরও বড় খরা নেমে আসে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের পর। কারণ, লোকসভা ভোটেও হেরে যান দিলীপ। জুন মাসে লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশ হয়। তার তিন মাসের মধ্যেই তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন রিঙ্কু মজুমদার। তার ৬ মাসের মধ্যেই যদিদং হৃদয় তব মন্ত্র যপে চার হাত এক করে ফেলেন দিলীপ।
আসলে রাজনৈতিক ভাবে উচ্চ পদে থাকলে দিনের ২৪ ঘণ্টা সময়ও যেন কম পড়ে। প্রেম, ভালবাসার মতো কোমল বিষয়গুলো তখন খুব একটা স্থান পায় না। সকাল থেকে রাত কেটে যায় শুধু লোকের সঙ্গে দেখা করতে বা কৌশল নির্ধারণে। সেই চরম ব্যস্ততার পর যখন ঝুপ করে শৈত্য নেমে আসে, তখন রাজনীতিকদের অনেকেরই বড় একা কাটে। রাজনীতি এতটাই নির্মম। তখনই হয়তো প্রিয়রঞ্জন, সোমেন, দিলীপরা এমন একজনকে খোঁজেন যিনি সুখের মতোই দুঃখে ও হতাশাতেও পাশে থাকবেন।
প্রিয়, সোমেন বা দিলীপের বিয়ে তাই আলাদা কোনও উপাখ্যান নয়। বরং একই উপন্যাসের যেন তিন চরিত্র।
Advertisement
Advertisement