শেষ আপডেট: 17th January 2025 18:52
রূপক মিশ্র
ভৌগোলিক নিরিখে দূরত্ব সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটারের কিছুটা বেশি। টিনটিন অনুরাগীদের চোখে ব্রাসেলস থেকে বাংলার এই ব্যবধান অবশ্য স্রেফ খাতায়-কলমে। নইলে তামাম বাঙালি ভিনদেশের অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় এক খুদে তরুণকে সাগ্রহে আপন করে নেয় কী করে? কমিক্সের এক চরিত্র ধর্ম-বর্ণ-বয়স নির্বিশেষে সক্কলের আপনজন হয়ে ওঠে কোন উপায়ে?
১০ জানুয়ারি, ১৯২৯। ‘ল্য ভাঁতিয়েম সিয়েকল’ নামক সংবাদপত্রের ক্রোড়পত্রে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে টিনটিন। বাংলায় ভূমিষ্ঠ হয় সাতের দশকে। কিন্তু সরাসরি অনূদিত রূপে ‘আনন্দমেলা’র পাতায় এই কমিক্স জায়গা করে নেয়নি। কলকাতার আগে মুম্বই ঘুরে আসতে হয়েছে তাকে। সৌজন্যে দুটি শিশুতোষ পত্রিকা—’অমর চিত্রকথা’ এবং ‘টিঙ্কল’। ছয়ের দশকে এদের সৌজন্যেই সারা ভারতে কমিক্স-কালচার গড়ে ওঠে, ধীরে ধীরে আদৃতও হয়।
তবে স্রেফ মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে রেখা ও লিপি সাজিয়ে তুলত না তারা। লক্ষ্য ছিল প্রধানত ছেলেমেয়েদের ‘শিক্ষে দেওয়া’। ভারতের পুরাণ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, নৈতিকতা সম্বন্ধে ছোটদের অবহিত করে তোলা। দুটি ম্যাগাজিন গড়ে দেয় ভিত। একটা জমি প্রস্তুত করে। যে জমিতে কয়েক বছর বাদে শত পুষ্পে বিকশিত হবে টিনটিন। তারপর অ্যাসটেরিক্স।
ভারতের বাজার ধরার চিন্তা লেখক অ্যার্জের মনে কোনওকালে ছিল না। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের পপুলার কালচার দু’হাত দিয়ে পরদেশি সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করে ফেলল ঠিকই। কিন্তু এ বিষয়ে ন্যূনতম আগাম আন্দাজ করতে পারেননি অ্যার্জে।
অথচ লেখকের অবচেতন মনের কী মহিমা! ভারতকে আলগোছে ছুঁয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। এক নয়, একাধিক প্রসঙ্গে!
‘ফ্যারাওয়ের চুরুটে’র কথাই ধরা যাক। সেখানে আমরা ড্রাগ স্মাগলারদের পিছু ধাওয়া করা টিনটিনকে গাইপাজামায় ‘ল্যান্ড করতে’ দেখি। এই গাইপাজামাকে অ্যার্জে ভারতের এক কাল্পনিক রাজ্য বলে উল্লেখ করেছেন। সেই রাজ্যের মহারাজার সঙ্গেও দেখা করে টিনটিন।
১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয় ‘ফ্যারাওয়ের চুরুট’। এর ন’বছর বাদে, ১৯৪১-এ আত্মপ্রকাশ করে ‘দ্য মিস্ট্রি অফ দ্য ব্লু ডায়মন্ড’। না, এটা কোনও কমিক্স নয়। তিন অঙ্কের নাটক। লেখক অ্যার্জে। সহ-লেখক তাঁর বন্ধু জ্যাক ম্যালকেবেকে। নাটকের রঙ্গভূমি পাড়াখোড় নামে এক রাজ্য। এও কাল্পনিক। কিন্তু ভারতের। ঠিক গাইপাজামার মতো। ব্রাসেলসের থিয়েটারে নাটকটি চুটিয়ে অভিনীত হয়। দুর্ভাগ্য এই, যে, ‘দ্য মিস্ট্রি অফ দ্য ব্লু ডায়মন্ডে’র মূল স্ক্রিপ্টটি আর পাওয়া যায় না, হারিয়ে গেছে। যদি যেত, তাহলে টিনটিনের ভারত-যোগ নিয়ে আরও নিবিড় আলোচনা, আরও চর্চা-তর্ক-বিতর্ক করা সম্ভব হত।
তবে অনুরাগীদের পুরোপুরি হতাশ করেননি অ্যার্জে। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘তিব্বতে টিনটিন’। সেখানে হিমালয় অ্যাডভেঞ্চারে যাওয়ার মাঝপথে দিল্লিতে হল্ট নেয় টিনটিন ও ক্যাপটেন হ্যাডক। দুজনেই রাজধানীর রূপে মুগ্ধ; লালকেল্লা, কুতুব মিনার দেখে বাকস্তব্ধ। অ্যার্জের আঁকায় ভারতীয় ঐতিহ্য ও ইতিহাসের এই দুই দলিল জীবন্ত হয়ে দেখা দিয়েছে। এক বিদেশি লেখকের এহেন সশ্রদ্ধ উল্লেখ পাঠকদের অনুরক্তি ও আগ্রহকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ।
আর এই আগ্রহের ফসল ফলল ১৯৭৫ সালে। ‘আনন্দমেলা’র পাতায় আত্মপ্রকাশ করল টিনটিন। প্রথম ভারতীয় ভাষা হিসেবে অ্যার্জের ‘অমর চিত্রকথা’ অনুবাদের গৌরব পেল বাংলা। কিন্তু বাংলা ছাড়িয়ে অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষা, বিশেষত হিন্দিতে অনূদিত হতে টিনটিনকে আরও অনেকটা বছর অপেক্ষা করতে হবে। তিরিশ বছর বাদে, ২০০৫-এ এসে হিন্দিতে তরজমার তোড়জোড় শুরু করে প্রকাশনা সংস্থা ‘ওম বুক ইন্টারন্যাশনালস’। সংস্থার প্রধান অজয় মাগো হিন্দি অনুবাদের স্বত্ব কিনতে চান। কিন্তু অনুবাদ করবে কে? শুধুমাত্র ভাষার ওপর দখলই তো যথেষ্ট নয়। হতে হবে টিনটিনপ্রেমী। আছে কেউ এমন, যে কিনা শয়নে-স্বপনে, নিশি-জাগরণে টিনটিনের আজব দুনিয়ায় বেঁচে থাকে?
উত্তর পেতে অ্যার্জের কমিক্সের বেশ কিছু নমুনা অনুবাদ করে জমা দেওয়ার আহ্বান জানান অজয়। সাড়া আসে বিলক্ষণ। কিন্তু কোনও তরজমাই দাগ কাটে না। দিন গড়ায়, মাস গড়ায়। মনের মতো অনুবাদক খুঁজে পেতে বছর ঘুরে যায়। অবশেষে ২০০৭ সালে অজয় সন্ধান পান পুনীত গুপ্তার। বিজ্ঞাপন দুনিয়ার মানুষ। সাবলীল অনুবাদ, ঝরঝরে ভাষা। ভেবেচিন্তে পুনীতকেই বেছে নেন তিনি।
পরে একটি সাক্ষাৎকারে এই অনুবাদক বাছাইয়ের চারটি শর্তের উল্লেখ করেছিলেন অজয়। শর্তগুলি ছিল:
১. অনুবাদককে অবশ্যই ‘টিনটিনের পোকা’ হতে হবে।
২. হিন্দি ভাষাজ্ঞান ও রচনাদক্ষতা থাকতে হবে।
৩. শুধু ইংরেজি নয়, মূল ফরাসি থেকেও ‘ইনপুট’ নেওয়ার বিষয়ে তিনি কতটা আগ্রহী, নজর থাকবে সেদিকেও।
৪. সবচেয়ে জরুরি লিটমাস টেস্ট এই চার নম্বর শর্ত। ক্যাপটেন হ্যাডকের সিগনেচার বুলি ‘billions of blue blistering barnacles’ অনুবাদে তিনি কতটা দড়, সেটা যাচাই করে দেখা হবে! প্রথম তিনটে উতরে গিয়েও শেষ ধাপে পিছল খেলেই বাতিল—সাফ নির্দেশ দিয়েছিলেন অজয়।
তাড়াহুড়ো করতে চাননি প্রকাশক। অনুবাদক পুনীত সময় নেন। দীর্ঘ সময়। ২০০৭ থেকে ২০১০। পাক্কা তিন বছর ধরে অনুবাদের কাজে মজে থাকেন তিনি। অবশেষে ডিসেম্বর মাসে ছেপে বেরোয় টিনটিনের মোট ১৬টি বই।
বাংলা না হিন্দি—কোন ভাষার অনুবাদ স্বচ্ছতর, সার্থকতর হয়েছে? প্রশ্ন উঠলে ভোটাভুটি হবে। কিন্তু বিজয়ী ঘোষণা কিঞ্চিৎ কঠিন। কারণ, দুই ভাষাই দুটো আলাদা সংস্কৃতি-বলয়কে ধরে রেখেছে। তুলনা টানা খানিক অসম্ভবই বটে। তবু বাংলার পেলবভূমিতে জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি বলেই হয়তো স্নোয়ির নামান্তর ‘নটখট’, থম্পসন ও থমসনের রূপান্তর ‘সান্টু ঔর বান্টু’, প্রফেসর ক্যালকুলাসের ভাষান্তর ‘প্রফেসর আর্যভট্ট সূর্যমুখী’ আমাদের কানে বাজে! হাড় কামড়াতে ভালোবাসে যে কুকুর, তার নাম যে ‘কুট্টুস’ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না—এই সওয়াল তুললে তাকে নাকোচ করাটা কষ্টকরই বটে!